
শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ভারত থেকে অবাধে সুতা আনা হচ্ছে। স্থলবন্দরের ওপর কার্যকর নজরদারি না থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশীয় টেক্সটাইল শিল্প। ডলার সংকট, ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের অভাব, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে টিকতে না পেরে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে নতুন বিনিয়োগ তো দূরের কথা, একটার পর একটা কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।
রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মঙ্গলবার এ উদ্বেগের কথা জানান বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি (বিটিএমএ) শওকত আজিজ রাসেল। ঢাকা আন্তর্জাতিক টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট মেশিনারি এক্সিবিশন (ডিটিজি) উপলক্ষ্যে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। আগামী ২০-২৩ ফেব্রুয়ারি ডিটিজির ১৯তম সংস্করণ আন্তর্জাতিক কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় (আইসিসিবি) অনুষ্ঠিত হবে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, বাংলাদেশের শিল্পের ইতিহাসে অস্থিরতা ছিল, আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। সব উদ্যোগই সফল হয় না। কিছু উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেলে, শ্রমিকদের চাকরি চলে গেলে কিছুটা অস্থিতরতা দেখা দেবে। এটাই স্বাভাবিক। এজন্য সরকারের কাছে আমরা এক্সিট প্ল্যান চেয়েছি। বর্তমানে শিল্পের পুঁজি অর্ধেক হয়ে গেছে। তারল্যের সংকট ব্যাংক আমলে নিচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে এখনই উদ্যোগ না নিলে কারখানা চালানো কঠিন হয়ে পড়বে।
বিদেশি বিনিয়োগ প্রসঙ্গে রাসেল বলেন, প্রতিনিয়ত চায়নার জুতার কারখানা বন্ধ হচ্ছে। এসব কারখানা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্থানান্তর হচ্ছে। বাংলাদেশ ছিল বিদেশি উদ্যোক্তাদের শিল্প স্থানান্তরের প্রধান পছন্দ। তারা শিল্প স্থানান্তর করলে দেশের লাভ হতো। তাদের কাছে প্রযুক্তি পাব, কর্মসংস্থান হতো। কিন্তু সমস্যা একটাই- বাংলাদেশে রাতারাতি ইউটিলিটির (গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি) দাম দ্বিগুণ-তিনগুণ করে দেয়। এ রকম ভবিষ্যতেও থাকলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। সরকারকে অন্তত ১০ বছরের জন্য ইউলিটির দাম ফিক্সড করে দিতে হবে। তাহলে বিদেশি ঝুঁকি নিতে আগ্রহী হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন শিল্প স্থাপনে দেশি উদ্যোক্তাদেরও ১০ বার ভাবতে হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, কর্মসংস্থান করতে না পারলে চাঁদাবাজি হবেই। সরকার শ্রমঘন শিল্পের জন্য নীতি দিতে না পারলে দেশে কর্মসংস্থান হবে কোত্থেকে। সরকার বিনাপ্রশ্নে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ এবং ২৫ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ায় আজকে তৈরি পোশাকশিল্প মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছে। ম্যান মেইড ফাইবার এখন বিশ্ববাজারে ৭০ শতাংশ দখল করে রেখেছে। অথচ সরকার ম্যান মেইড ফাইবারের জন্য নীতি গ্রহণ করছে না।
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আক্ষেপ করে রাসেল বলেন, সরকার গ্যাসের যে দামই নির্ধারণ করে দিয়েছে, আমরা সে দামেই গ্যাস কিনছি। অথচ গ্যাস পাইনি, এখনো পাচ্ছি না। গ্যাস সংকট কারণ সময়মতো কূপ খনন করা হয়নি। এর পরিবর্তে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা হয়েছে। এখনো বিদেশে বসে বসে তারা কমিশন পাচ্ছে। আবার ব্যাংকের টাকায় পাওয়ার প্ল্যান্ট করা হয়েছে। অথচ তাদের বিল দেওয়া হচ্ছে ডলারে। এর কোনো যৌক্তিকতা নেই। এটা এক ধরনের মানি লন্ডারিং। এসব চুরিচামারির দায় শিল্পের ওপর বর্তাচ্ছে। প্রকৃত শিল্পমালিকরা কষ্ট পাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, গ্যাসের দাম কী হবে সেটা ব্যবসায়ীদের জানানো না হলে নতুন বিনিয়োগ আসবে না। ঘুম থেকে ওঠার পর যদি শুনি গ্যাসের দাম ৭৫ টাকা তাহলে বাংলাদেশে শিল্প টেকসই হবে কীভাবে? রাতারাতি কারখানা একটার পর একটা বন্ধ হবে। জ্বালানির দামে অনিশ্চয়তা থাকলে কোনো শিল্পমালিক নতুন বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন না। বরং পুরোনোগুলো মেরে ফেলার চক্রান্ত হচ্ছে। কারখানাগুলো ডলার সংকটে কাঁচামাল আমদানি করতে পারছে না। আগে পুরোনোদের সাপোর্ট দিতে হবে। গ্যাসের দাম কত দিন কত থাকবে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।
সুতা আমদানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০২৪ সালে বৈধপথে ভারত থেকে ২৭০ কোটি ডলারের সুতা আমদানি হয়েছে। অবৈধপথে কী পরিমাণ আমদানি হয়েছে, তার ধারণাও করা যাচ্ছে না। কারণ বন্দরে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ভারত থেকে সুতা আনায় সে দেশে দেড় লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হলো, মূল্য সংযোজনটা সে দেশে হলো, আর বাংলাদেশের শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলো। ভারতে অভ্যন্তরীণ বাজারে ব্যবহারের সুতার চেয়ে রপ্তানির সুতার দাম কম। কারণ তারা রপ্তানিকে প্রাধান্য দেয়। বাংলাদেশ সরকারের এদিকে মনোযোগ নেই।
কেন সুতা আমদানি হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে রাসেল বলেন, গ্যাস, কাঁচামাল সংকটের কারণে টেক্সটাইল মিলগুলো খুঁড়িয়ে চলছে। এ অবস্থায় গার্মেন্ট মালিকরা ঝুঁকি নিতে পারেন না। তারা সময়মতো সুতা পেতে ভারতের দিকে ঝুঁকছেন। আগামী ৩-৪ মাসে ভারতে সুতার অর্ডার বুকড করা আছে। এই সরবরাহগুলো বাংলাদেশের টেক্সটাইল মিলগুলো দিতে পারত। সরকারের কাছে স্থলবন্দরের মাধ্যমে সুতা আমদানি বন্ধের আবেদন জানিয়েছি। কারণ চোরাচালানের মাধ্যমে প্রচুর সুতা বাংলাদেশে আসছে। ১০ টনের এলসি দিলে ২ টন করে ৫ বার সুতা আসছে। প্রতিবারই ২ টনের বেশি সুতা আনা হয়। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা এসব সুতা স্থানীয় শিল্পকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ঢাকা আন্তর্জাতিক টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট মেশিনারি এক্সিবিশন (ডিটিজি) আয়োজন করা হচ্ছে। আগামী ২০ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় (আইসিসিবি) অনুষ্ঠিত হবে। ৩৩টি দেশের এক হাজার ৬০০টি স্টল এবং এক হাজার ১০০টিরও অধিক শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড সম্মিলিতভাবে প্রদর্শনীতে টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট খাতের সর্বাধুনিক প্রযুক্তিগুলো প্রদর্শন করবে। চীন, জার্মানি, ভারত, ইতালি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্কসহ বিশ্বের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান প্রদর্শনীতে অংশ নেবে। মেলায় প্রদর্শিত হবে টেক্সটাইল মেশিনারি, ফ্যাব্রিক, ফিলামেন্ট, কেমিক্যালস, ডাইং প্রযুক্তি এবং অ্যাক্সেসরিজ।