ষড়যন্ত্র করে খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের নেপথ্যে ছিলেন যারা

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশের সময়: শুক্রবার, ২০ জুন, ২০২৫ । ৩:১০ অপরাহ্ণ

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশে থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন বিতর্কিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। তার পালানোর পর আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন আরেক কাঠি সরেস, বিতর্কিত সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। এরপর থেকে অনেকটা লাপাত্তা তিনি। এ-কথা ওপেন সিক্রেট যে, তার ভয়াল হাতের ছোঁয়ায় দেশের বিচার বিভাগ ও গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে গেছে। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের নেপথ্যেও ছিলেন এবিএম খায়রুল।

সার্বিক অনুসন্ধান ও তথ্য বলছে- সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের নেপথ্যে ছিলেন খায়রুল হক, মোজাম্মেল হোসেন ও সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এস কে সিনহা)। খায়রুল হকের নেতৃত্বে এই তিনজনের আপিল বিভাগের বেঞ্চেই শুনানি ছাড়া বাড়ি থেকে উচ্ছেদের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছিল। খালেদা জিয়ার আবেদনের শুনানি ছাড়াই তারা একতরফা রায় দিয়েছিলেন।

বিচারাঙ্গনে আলোচিত-সমালোচিত এই বিচারপতির আচরণের চেয়েও বেশি বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল তার কয়েকটি রায়, যা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য সুবিধাজনক বা এর সমর্থনসূচক ছিল। এসব রায় নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পাশাপাশি তার নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। তিনি নিজে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানাভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল কয়েকজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে ডিঙিয়ে। এমনকি প্রধান বিচারপতি থাকাকালে ত্রাণ তহবিলের টাকা গ্রহণ করে নিজের চিকিৎসা করে সমালোচিত হয়েছিলেন। অবসর গ্রহণ করার কয়েকদিন আগে তিনি ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেন; যার ফলে দেশে রাজনৈতিক সংঘাতের পথ উন্মুক্ত হয়। নিজেরই দেওয়া সংক্ষিপ্ত আদেশ থেকে বিতর্কিতভাবে সরে এসে রায় দেন, যার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ভোট ডাকাতির চূড়ান্ত সুযোগ তৈরি হয়।

এসব অপকর্ম ছাড়াও খায়রুল হক নানা কারণে সমালোচিত ছিলেন। রাজনৈতিক একটি বিষয়কে আদালতের আওতাধীন করে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক নন বলে রায় দিয়েছিলেন তিনি। ওই রায় রাজনৈতিক শক্তিগুলোর একটি অংশকে যেমন খুশি করেছিল, অন্য অংশকে তেমনই ক্ষুব্ধ করেছিল। রাজনৈতিক বিষয়ে ওই রায়ের সঙ্গে তার প্রতি সরকারের বিশেষ সুদৃষ্টির সম্পর্ক নিয়ে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন অস্বস্তিকর সন্দেহ ছিল। সেই সন্দেহ তিনি উসকে দেন অবসর গ্রহণের প্রায় দুই বছর পর আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণ করে। মূলত দেশের বিচার বিভাগের উচ্চাসনে বসে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করাই ছিল তার মূল কাজ।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ১৩ আগস্ট খায়রুল হক আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর একাধিক মামলা দায়েরের পর গা ঢাকা দেন। ১৮ আগস্ট ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য ইমরুল হাসান বাদী হয়ে ঢাকার আদালতে খায়রুল হকের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় খায়রুল হকের বিরুদ্ধে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পরিবর্তন এবং জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়। ২৮ আগস্ট দুর্নীতি ও রায় জালিয়াতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করেন আরেক আইনজীবী। এর আগে ২৫ আগস্ট খায়রুল হকের বিরুদ্ধে একই বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায় আরেকটি মামলা হয়। তাকে গ্রেফতার ও শাস্তির দাবিতে সুপ্রিমকোর্টে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামসহ বিভিন্ন সংগঠন।

অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান সম্প্রতি এক সভায় বলেন, বিচারাঙ্গনে কোনো মাফিয়া থাকবে না, কোনো চক্রের সিন্ডিকেট থাকবে না। সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক এবং সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে ভোটের অধিকার হরণ নিশ্চিত করেছিলেন। সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল অবেদীন গণমাধ্যমে বলেন, বিচার বিভাগ ও গণতন্ত্র ধ্বংসকারী ছিলেন বিচারপতি খায়রুল হক। তাকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা দরকার।

ঘটনার এখানেই শেষ নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলেও খায়রুল হক, মোজাম্মেল হোসেন, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা-এই তিনজনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। এমনকি আপিল বিভাগে ৭ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে প্রকাশ্যে দেওয়া রায়ের মূল অংশ ছিল পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে। ওই অংশকে চূড়ান্ত রায়ে গায়েব করে দেন খায়রুল হক। তার সঙ্গে একমত হন মোজাম্মেল হোসেন, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।

২০০৯ সালে হাইকোর্টের বিচারপতি থাকাকালে জিয়াউর রহমান নন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক বলে রায় দেন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। রায়ে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক উপস্থাপন করে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, দলিলপত্র’-এর তৃতীয় খণ্ড বাতিল ঘোষণা করেন। এই খণ্ডটি দেশবিদেশের সব স্থান থেকে বাজেয়াপ্ত ও প্রত্যাহারেরও নির্দেশ দেন খায়রুল হক। রায়ে বলা হয়, যারা এরকম ইতিহাস বিকৃতির সঙ্গে জড়িত, তারা সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। দেশের সব মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রমে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস বাধ্যতামূলকভাবে সন্নিবেশ করার জন্যও সরকারকে নির্দেশ দেন এই বিচারপতি।

প্রধান বিচারপতি হিসেবে তার দেওয়া অনেক বিতর্কিত রায়ের মধ্যে একটি হচ্ছে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের আগাম জামিনের এখতিয়ার কেড়ে নেওয়া। খায়রুল হক, মোজাম্মেল হোসেন ও সুরেন্দ্র কুমার সিনহা মিলে একটি আগাম জামিনের আপিলের রায়ের মাধ্যমে এখতিয়ার কেড়ে নেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের। তখনই হাইকোর্ট বিভাগে আগাম জামিন পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ওই আদেশের পর আগাম জামিনের জন্য এলে তাকে নিম্ন আদালতে হাজির হয়ে জামিন চাইতে একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়।

চক্রের ফিরিস্তি আরও আছে। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান থাকাকালে এবিএম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। আইন কমিশনে গাড়িচালক হিসাবে চাকরি করতেন এসএম সামসুল আলম। ২০১৩ সালে ক্ষমতার ব্যবহার করে সামসুল আলমকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠান খায়রুল হক। সামসুল আলম চাকরি হারিয়ে অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সম্প্রতি তিনি চাকরি ফেরত চেয়ে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর আবেদন করেছেন।

২০১১ সালে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসরের পরপরই তাকে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দিয়ে পুরস্কৃত করেন শেখ হাসিনা। গত ১৩ আগস্ট পদত্যাগ করে আড়ালে চলে যান খায়রুল হক। একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, খায়রুল হক প্রথমে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। সেখান থেকে পাড়ি দেন যুক্তরাজ্যে। সেখানে তার মেয়ের বাসায় ওঠেন। বর্তমানে তিনি ওই বাসায় নেই, অন্য কোথাও আত্মগোপনে রয়েছেন। ছেলে মো. আশিক উল হক ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন। সুপ্রিমকোর্টে আইনজীবী হিসেবেও কাজ করছেন তিনি।

বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করে খায়রুল হক কোথায় আছেন জানতে চাইলে ছেলে মো. আশিক উল হক বলেন, বাবা যেখানে থাকার, সেখানেই আছেন। মামলার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আদালত থেকে আমরা কিছু পাইনি। কিছু পেলে যেটা করা প্রয়োজন অবশ্যই করবো।

সম্পাদক: মোঃ শাহ্ আলম খান। বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১০১/বি, (২য় তলা), মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, ঢাকা-১২১৯। মোবাইলঃ +৮৮-০১৬০১-৫৬৩৯৯৯, ফোনঃ +৮৮০২২২৬৬৬৩৯৯১, ইমেইল : infobdnews999@gmail.com, ওয়েব সাইট : www.bdnews999.com

প্রিন্ট করুন