বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, যা কিছুই ঘটুক না কেন, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সম্পন্ন করে আগামী ১৮ মাসের মধ্যে যেন নির্বাচন হতে পারে সেজন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সব ধরনের সহায়তা করা হবে। সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এমনটি জানান।
বিরল এই সাক্ষাৎকারে রয়টার্সকে সেনাপ্রধান জানান, শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। তাছাড়া, তিনি নিজেও সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত করতে চান বলে জানান।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত আগস্টের শুরুতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এবং সেনাবাহিনী কোনো বাধা দেয়নি। আর এতেই শেখ হাসিনার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায় এবং ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর তিনি পদত্যাগ করে প্রতিবেশী ভারতে পালিয়ে যান।
এমন অবস্থায় সোমবার রাজধানী ঢাকায় নিজের কার্যালয়ে রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জেনারেল ওয়াকার বলেন, ‘যাই হোক না কেন আমি মুহাম্মদ ইউনূসের পাশে আছি, যাতে তিনি তার মিশন সম্পন্ন করতে পারেন।’
বিশ্বব্যাপী ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের অগ্রদূত ড. ইউনূস ১৭ কোটি মানুষের দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ প্রশস্ত করতে বিচার বিভাগ, পুলিশ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার কয়েক সপ্তাহ আগেই সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পান ওয়াকার-উজ-জামান। তার মতে, এমন পরিস্থিতি থেকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণ করতে এক থেকে দেড় বছর সময় নেওয়া উচিত। এসময় তিনি সবাইকে ধৈর্য্য ধারণের আহ্বান জানান।
রয়টার্স জানিয়েছে, গত আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) উভয়ই আগামী তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছিল।
সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও তিনি প্রতি সপ্তাহেই বৈঠক করেন এবং তাদের মধ্যে একটি ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, আমরা যদি একসঙ্গে কাজ করি, তাহলে ব্যর্থ হওয়ার কোনো কারণ নেই।’
গত জুলাইতে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়, পরে তা সরকারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। এই আন্দোলন চলাকালে এক হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, যা স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন।
শেখ হাসিনার পতনের পর আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা রাজধানী ঢাকা এখন অনেকটাই শান্ত। তবে সরকার পতনের পর প্রশাসনের কিছু অংশ এখনো সঠিকভাবে কার্যকর হয়নি। প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার সদস্যের বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী এখনও বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে। এজন্য দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করছে বাংলাদেশে সেনাবাহিনী।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে জন্ম নেয় বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সালে শেখ হাসিনার বাবা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর দেশে সামরিক শাসন শুরু হয়। এরপর ১৯৯০ সালে সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এরশাদ একটি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন, যার ফলে গণতন্ত্র ফিরে আসে।
এরপর ২০০৭ সালে সামরিক বাহিনী আবার একটি অভ্যুত্থান ঘটায় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সমর্থন জানায়। দুই বছর পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত ওই সরকার শাসন করেছিল।
দীর্ঘ কর্মজীবনে একজন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে ওই অস্থির সময়গুলোতে দায়িত্ব পালন করেছেন জেনারেল ওয়াকার। তিনি বলেছেন, তিনি যে বাহিনীর নেতৃত্ব দেন তারা রাজনৈতিকভাবে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। ‘আমি এমন কিছু করবো না, যা আমার বাহিনীর জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমি একজন পেশাদার সৈনিক। আমি আমার বাহিনীকেও পেশাদার রাখতে চাই’ বলেন তিনি।
সেনাপ্রধান জানান, সরকার পতনের পর সংস্কারের অংশ হিসেবে কিছু সেনা সদস্যের বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগও খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং কয়েকজনকে এরই মধ্যে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। তবে এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি তিনি।
ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, যদি কোনো দায়িত্বরত সদস্য দোষী সাব্যস্ত হন, অবশ্যই আমি ব্যবস্থা নেবো। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরাসরি নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলোতে কাজ করার সময় কিছু সামরিক কর্মকর্তা আইন বহির্ভূত কাজ করেছেন বলেও স্বীকার করেন তিনি।
২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী জোরপূর্বক ‘গুম’ করতে পারে এমন প্রায় ৬০০ জনের অভিযোগ তদন্তের জন্য হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
দীর্ঘ মেয়াদে জেনারেল ওয়াকার সেনাবাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে চান। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ১ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি সৈন্য রয়েছে এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অন্যতম প্রধান সেনা প্রেরণকারী দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ।
রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য চান সেনাপ্রধান
সেনাপ্রধান বলেন, সামগ্রিকভাবে সামরিক বাহিনীকে কখনোই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা উচিত নয়। একজন সৈনিককে রাজনীতি করা উচিত নয়।
ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত তখনই রাখা যেতে পারে যখন রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকে। এমন ব্যবস্থায় সশস্ত্র বাহিনীকে সরাসরি রাষ্ট্রপতির অধীনে রাখা যেতে পারে।
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী বর্তমানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে, যা সাধারণত প্রধানমন্ত্রী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সাংবিধানিক সংস্কারের সময় এ বিষয়ে সংশোধন চান ওয়াকার-উজ-জামান।
তথ্যসূত্র : রয়টার্স