তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করে আনা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতা নিয়ে জারি করা রুলের ওপর তৃতীয় দিনের মতো শুনানি শেষ হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (০৭ নভেম্বর) বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি শেষে রোববার পরবর্তী দিন রেখেছেন।
এ দিন বিএনপির পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন এবং আগের দিন বদিউল আলমসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে শুনানি শেষ করেন সিনিয়র আইনজীবী ড. শরিফ ভূঁইয়া।
শুনানি শেষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, বলা হয়েছিল আদালতের রায়ে সংবিধান পরিবর্তন (পঞ্চদশ সংশোধনী) করা হয়েছে। কিন্তু আদালতের সংক্ষিপ্ত রায়ে (তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনী) বলা হয়েছে, দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। ওই মামলায় ৭ জন অ্যামিকাস কিউরি ছিলেন। শুধু একজন অন্যভাবে মত দিয়েছেন। মেজরিটি বলেছে, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সঠিক। সংক্ষিপ্ত রায়ের সাত দিন পরে সংবিধান সংশোধন (তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে আনা পঞ্চদশ সংশোধনী) হয়ে গেছে। পরবর্তীতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক অবসরে চলে গেছেন। তার ১৬ মাস পরে তিনি রায় লিখলেন। আমি তখন বলেছিলাম, এ রায়কে রায় বলা যায় না। (পঞ্চদশ) সংশোধনীটা সংবিধানের লঙ্ঘন হয়েছে। (আদালতে) সেই সমস্ত দিক তুলে ধরেছি। আমরা বলেছি, এটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তবে কিছু কিছু বিধান থাকা দরকার, সেটা পরবর্তীতে আদালতের কাছে উপস্থাপন করব।
জয়নুল আবেদীন আরও বলেন, আমরা চ্যালেঞ্জ করে বলেছি, এটা (পঞ্চদশ সংশোধনী) সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা যথাযথভাবে হয়নি। আদালতের রায় অনুসারে হয়নি। সরকার নিজের ইচ্ছামতো সংধোশনীটি করেছে। এ সংধোধনীটি আইনের চোখে অচল। এটা থাকতে পারে না। এটা বাতিলযোগ্য। আমরা আদালতের মাধ্যমে বাতিল চেয়েছি।
গত ১৯ আগস্ট জনস্বার্থে পাঁচজন বিশিষ্ট ব্যক্তির করা রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি শশাঙ্ক শেখর সরকারের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করেন।
পরে আবেদনকারী পক্ষ রুলটি শুনানির জন্য বিচারপতি ফারাহ মাহবুবের নেতৃত্বাধীন কোর্টে উপস্থাপন করেন। এরপর ৩০ অক্টোবর থেকে রুল শুনানি শুরু হয়।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি রিট করেন। অন্য চারজন হলেন—তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজ উদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান। এরপর এ রুলের ওপর মতামত দিতে বিএনপি, জামায়াত, গণফোরাম ও আইনজীবী মোস্তফা আসগর শরিফী প্রমুখ যুক্ত হন।
পঞ্চদশ সংশোধনী আইনে (২০১১) বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।
২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় এবং রাষ্ট্রপতি ২০১১ সালের ৩ জুলাই তাতে অনুমোদন দেন। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
এ ছাড়া জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়; সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল করা হয়। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয় ওই সংশোধনীর মাধ্যমেই।
রিটের পর ১৯ আগস্ট আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে আছে একসঙ্গে অনেকগুলো অনুচ্ছেদে পরিবর্তন বা সংশোধনী আনতে হলে গণভোট করতে হবে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের অনেকগুলো অনুচ্ছেদের পরিবর্তন আনা হয়। কিন্তু কোনো গণভোট করা হয়নি। গণভোট না করে সংশোধনী পাস করা সংবিধান পরিপন্থী। ’
‘তাছাড়া ত্রয়োদশ সংশোধনী সংক্রান্ত মামলার লিখিত সংক্ষিপ্ত আদেশে আপিল বিভাগ বলেছিলেন, পরবর্তী দুটি (দশম এবং একদশ) জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে হবে। কিন্তু সেই আদেশকে অমান্য করে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া হয়। ফলে দশম এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে না করে দলীয় সরকারের অধীনে করা হয়। এ কারণে পঞ্চদশ সংশোধনী আপিল বিভাগের আদেশের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক এবং সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিপন্থী’, বলেন আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া।