দীর্ঘদিনের স্বৈরাচারী শাসনে জর্জরিত বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ ও জনপদ। স্বৈরাচারী হাসিনার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সর্বশেষ ছাত্র জনতার যুগান্তকারী আন্দোলনে লজ্জাজনক পতন হয় শেখ হাসিনার। স্বৈরাচারী যুগের অবসান হলেও পুলিশ সহ বিভিন্ন দপ্তরে এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে স্বৈরাচারী দোসরদের এজেন্ট। তেমনি স্বৈরাচারী পুলিশ সদস্য রয়েছে কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা থানায়। বিশেষ করে ভেড়ামারা থানার ওসি শেখ শহিদুল ইসলাম, এএসআই (নিঃ) মোঃ আল আমিন (বিপিনং-৯৯১১১৫৫৭৫১), এসআই (নিঃ) সুভ রায় (বিপিনং-৯৪২০২২৬৭৪৮) ও এএসআই (নিঃ) এনামুল যেনো স্বৈরাচারের জীবন্ত উদাহরণ।
শুনতে অবাক লাগলেও এটাই নিদারুণ সত্য। পাবনা জেলার ঈশ্বরর্দীর মুলাডুলি গ্রামের মুরগীর খামারি ওমর ফারুক সহ ৩ জনকে রীতিমতো নাজেহাল করে অবশেষে জেলে পাঠিয়েছে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা। যা নিয়ে এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে তুমুল সমালোচনা।
ঘটনার সূত্রপাত গত ৩০ অক্টোবর ভেড়ামারা থানায় ৩টি মোটরসাইকেল চুরিকে কেন্দ্র করে। মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, “৩ জন অজ্ঞাতনামা চোর গত ৩০ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে রাত ৮টা ৫ মিনিটে থানার কম্পাউন্ডের সেডে প্রবেশ করে এবং ৩১ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে রাত ২ টা ৩৯ মিনিটে থানার ৩ টি মটর সাইকেল চুরি করে পালিয়ে যায়।”
অর্থাৎ পুলিশের কারসাজি মোতাবেক, কথিত চোর টানা ৬ ঘন্টা থানায় বিশ্রাম করছিলেন এবং পুলিশ হয়তো নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন। যার কারণে ৬ ঘন্টার মধ্যে কেউই চোরদের দেখেনি। এটা শুনতে আজগুবি কেচ্ছা মনে হলেও ঘটনা বাস্তবে রুপ নিয়েছে ভেড়ামারা থানায়।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর অভিযোগ, ‘যেদিন থানা থেকে মোটরসাইকেল চুরি হয় সেদিন পুলিশ কোথায় ছিলো ? চোর যদি ৬ ঘন্টা থানা কম্পাউন্ডের ভেতরে থাকে, তাহলে পুলিশের কেউ দেখলো না ? আর যখন জানাজানি হলো যে, মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে, তখন থানায় কোনো মামলা হলো না কেনো ? তারমানে পুলিশের মাঝে নিশ্চিত সমস্যা আছে। হয়তো তারা চিন্তা করেই রেখেছিল, এই মোটরসাইকেল চুরির ঘটনায় পথচারীদের আটক করে ইচ্ছামতো ঘুষ, জরিমানা আদায় সহ সুবিধামতো ফায়দা হাসিল করা যাবে।’
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, থানার বাইক হারিয়েছে ৩১ অক্টোবর। আর সেই রেশ ধরে ৩ জনকে আটক করা হয় ৬ নভেম্বর রাত আনুমাকি ১১টা ৪৫ মিনিটে। মূলত ওমর ফারুকের সাথে থাকা তার নিজস্ব ১৫০ সিসির নিবন্ধিত পালসার মোটরসাইকেলটিকে অনিবন্ধিত বলে চুরির অভিযোগ দেয়। এমনকি মামলার এজাহারে তার নিবন্ধিত বৈধ মোটরসাইকেল অবৈধ বলে জব্দ করে এবং মোটরসাইকেল চোর চক্রের সদস্য বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া হয়। পরবর্তীতে ৭ নভেম্বর কোনোপ্রকার তদন্ত ছাড়াই ওমর ফারুক, জামিল খান এবং হৃদয়কে উক্ত মামলায় ফাঁসানো হয়। তাদের পরিবারকে কোনো কিছু জানতে না দিয়ে তাদেরকে থানায় জিম্মি করে রেখে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল হাজতে প্রেরণ করে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, মোঃ ওমর ফারুক (২৯) বাড়িতে মুরগীর খামাড় দেখাশোনা করে। গত ৬ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে তার নিজস্ব রেজিষ্ট্রেশন করা একটি ১৫০ সিসির পালসার বাইক নিয়ে ভেড়ামারায় যান অন্যান্য মুরগির খামারে ভ্যাকসিন দিতে। কাজ শেষ করতে রাত হলে ওমর ফারুক তার ২জন বন্ধুর সহায়তা নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করে। আনুমানিক রাত ১১ টা ৪৫ এর সময় পুলিশ তাদের ২ জন বন্ধু সহ বাইক আটক করে এবং রেজিষ্ট্রেশন করা বাইক টি রেজিষ্ট্রেশন বিহীন বলে থানায় জব্দ করে। এরপর মোটর সাইকেল চুরির মামলায় অজ্ঞাত নামা আসামি করে কৌর্টে চালান করে।
গোপন সূত্রে আরো জানা যায়, আটক করার পর এএসআই আল আমিন অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে এবং এএসআই এনামুল একজনকে মারপিট শুরু করে। এরপর থানার মটরসাইকেল চুরির মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মোবাবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে মারতে মারতে ওমর ফারুক সহ সবাইকে থানায় নিয়ে যায়। সেখানে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে পরিবারের কারো সাথে যোগাযোগ না করে একপ্রকার জিম্মি করে রাখে তাদেরকে।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একজন অভিযোগ করেন, “এএসআই আলামিন বলে ‘আমাদের চুরি হওয়া মটরসাইকেলের দাম ৬,০০,০০০ (ছয় লক্ষ) টাকা দিয়ে দে। তাহলে তোকে এবং তোদের কে ছেড়ে দিবো। মূলত এএসআই আলামিনকে টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আলামিন এবং এএসআই এনামুল বলে শালাদের মামলা দিয়ে শুভ (এসআই শুভ মামলার তদন্তকারী অফিসার) কে দিয়ে রিমান্ডে নিয়ে এসে মারপিট করলেই টাকা এবং গাড়িও পাওয়া যাবে।”
আটককৃতদের এক ভাই বলেন, “যেহেতু থানার মটর সাইকেল চুরির সিসি ফুটেজ আছে। সেহেতু প্রকৃত চোর না ধরে অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্যই মিথ্যা মামলা দিয়ে আমার নিরিহ ভাইকে এসআই শুভ (মামলার তদন্তকারী অফিসার) রিমান্ডের হুমকি দিয়ে জেল হাজতে প্রেরন করে এবং আমার ভাইয়ের বৈধ মটর সাইকেলটি চুরির মটর মাইকেল বলে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধমে ছড়িয়ে দেয়। পরর্বতীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দিয়েই আমি আমার ছোট ভাইয়ের সন্ধান পাই। মূলত আমার ছোট ভাই মোঃ ওমর ফারুক ভেড়ামারা বিভিন্ন মুরগির খামাড়ে ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য এবং মুরগি দেখাশোনার জন্য যায় এবং ফিরতে রাত হলে তার বন্ধুদের সহযোগিতা নেয়। পরে রাস্তায় তাদের আটক করে উল্লেখিত অফিসারেরা এই এঘটনা ঘটায়। তাছাড়া সিসিটিভি ফুটেজ অনুযায়ী উক্ত মিথ্যা মামলার কোনপ্রকার মিল নেই।”
এবিষয়ে জানতে ভ্যাকসিন দিতে যাওয়া এলাকার বিভিন্ন খামারিদের সাথে কথা হয় গণমাধ্যম কর্মীদের। তারা বলেন, “ওমর ফারুক নিয়মিতই আমাদের এলাকায় মুরগির খামারে ভ্যাকসিন দিতে আসে। অনেক সময় রাত হলে তার পরিচিত বা বন্ধুদের নিয়ে বাসায় ফিরে। তাছাড়া তার নিজেরই একটা পালসার বাইক আছে। এটা করেই ফারুক নিয়মিত যাতায়াত করে। সেখানে অন্যের বাইক চুরির প্রশ্নই ওঠে না। পুলিশ তাদেরকে কেনো আটক করলো এবং কেনো মামলা দিয়ে জেলে পাঠালো তা আমাদের মাথায় ঢুকছে না।”
খামারিরা অভিযোগ করে বলেন, “খবর শুনে আমরা থানায় যায় এবং ওসি মহোদয়ের সাথে কথা বলি। আমরা বিস্তারিত বলে ওসি সাহেবকে বোঝায় যে, ওমর ফারুক নিয়মিত এই ভ্যাকসিনের কাজ করে এবং প্রায়শই তার ফিরতে রাত হয়। তাছাড়া এই মোটরসাইকেলও ওমর ফারুকের। তাই বাইকের কাগজপত্র যাচাই করে তাদেরকে ছেড়ে দিন। কিন্তু ওসি সাহেব মোটরসাইকেলের কাগজপত্র চেক না করেই বলেন এটা চোরাই, অবৈধ এবং রেজিষ্ট্রেশন বিহীন গাড়ি। আমরা তাদেরকে আটক করেছি, এখন ছাড়বো না। আগামীকাল আদালতে গিয়ে তাদেরকে ছাড়িয়ে আনবেন।”
সোশ্যাল মিডিয়া ও কুষ্টিয়ার স্থানীয় কিছু অনলাইন গণমাধ্যমে ঘটনাটি ছড়িয়ে গেলে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, “মূলত ওসি সাহেব আমাদেরকে ফোন করে বলেন, মোটরসাইকেল চোর চক্রের ৩ সদস্য মোটরসাইকেল সহ আটক হয়েছে। তখন আমরা থানায় গিয়ে আটককৃতদের ছবি তুলি এবং ওসি সাহেবের বক্তব্য মোতাবেক সংবাদ প্রকাশ করি। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা জানতে পারি, ঘটনাটি অন্য দিকে মোড় নিয়েছে। মূলত জব্দকৃত বাইকটি সম্পূর্ণ বৈধ এবং বৈধ কাগজপত্র রয়েছে। বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও ওসি মহোদয় মিডিয়াকে ব্যবহার করে নাটকীয় মামলা দিয়ে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেন।”
ঘটনার বিষয়ে একজন প্রবীণ সাংবাদিক ওসিকে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তাদেরকে ডাকাত সন্দেহে এলাকাবাসী আটক করে মারপিট করে। পরে আমরা তাদেরকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসি।”
কিন্তু মামলার এজাহারের সাথে ওসির বক্তব্যের কোনো মিল নেই। তাছাড়া ভুক্তভোগীদের পরিবার, স্থানীয় খামারি সহ সকলের বক্তব্যের সাথে ওসির বক্তব্য সম্পূর্ণ বিপরীত।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করতে ওমর ফারুকের নিজ গ্রাম ও ইউনিয়ন পরিষদে খোঁজ নেয়া হয়। এলাকার সবাই ওমর ফারুক সম্পর্কে ইতিবাচক বক্তব্য দেন। এমনকি তাদেরকে মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে আটকের কথা শুনে সবাই রীতিমতো ক্ষুব্ধ। এছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ইউপি চেয়ারম্যান ওমর ফারুক সম্পর্কে বলেন, “আমরা ওমর ফারুককে ভালো ছেলে হিসেবেই জানি। সে মুরগির খামার দেখাশোনা করে। তাছাড়া বিভিন্ন যায়গায় সে ভ্যাকসিন দিতেও যায়। তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।”
সুতরাং ঘটনার সার্বিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী বোঝা যায়, স্বৈরাচারী শাসনামলে পুলিশের যে একনায়কতন্ত্র ছিলো, তারা তেমনই রয়েছে। ঘটনার পরিক্রমায় পুলিশ সাধুর বেশ ধারণ করলেও তাদের কার্যকলাপ ও চরিত্রে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ এটাকে বলা যায়, “পুরাতন পণ্যের নতুন মোড়ক।”