বহুল বিতর্কিত গ্রেনেড মেরে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলায় সব আসামিকে খালাস দিয়ে হাই কোর্টের দেওয়া রায় প্রত্যাখ্যান করেছে আওয়ামী লীগ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত দলটি আজ রবিবার (১লা ডিসেম্বর) রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, “ইউনূসের ক্যাঙ্গারু কোর্ট নয়, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার করবে বাংলাদেশের জনগণ।”
গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা দেশে ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর আওয়ামী লীগের নানা বিবৃতি দলের বিভিন্ন বিতর্কিত আইডি সহ ভেরিফায়েড ফেইসবুকে আসছে। উল্লেখিত রায়ের প্রতিক্রিয়াও সেখানেই আসে।
গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমলে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না বলেই ইঙ্গিত করেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু বিতর্কিত আওয়ামিলীগের অভিযোগ শুনে রীতিমতো পাগলের প্রলাপ বলছেন সচেতন মানুষ।
কারণ গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেই সমালোচনা ছিল যে তারা আদালতকে নিয়ন্ত্রণ করতো। এমনকি সুবিধামতো রায় দেয়াতো শেখ হাসিনার সরকার। দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অভিযোগ ছিলো, তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে এই মামলায় জড়ানো হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ আমলে ২০১৮ সালে বিচারিক আদালতে দেওয়া এই মামলার রায়ে ৪৯ আসামির সবাইর সাজা হয়েছিল।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, তৎকালীন উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল ঢাকার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সেই রায়ে। তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। বাকি ১১ আসামির বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডাদেশ হয়।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর রবিবার হাই কোর্ট মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন ও আপিলের রায়ে সব আসামিকে খালাস দেয়। উচ্চ আদালত বলেছে, বিচারিক আদালতের রায়টি ছিল অবৈধ, তা সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে দেওয়া হয়নি।
এই মামলাটি হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা নিয়ে। সেই হামলায় দলটির ২৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হয়, আহত হয় অনেকে। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রাণে বেঁচে গেলেও তার শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়।
তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার সেই ঘটনা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল; তখন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইও এসেছিল তদন্তে। যদিও দেশের সর্বমহলে এই হামলাকে নাটক বলে সম্বোধন করা হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় কেউ মুখ খুলতে সাহস করেনি।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে এই ঘটনার তদন্ত পেরিয়ে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে শুরু হয়েছিল আলোচিত এই ঘটনার বিচার। তখন ২২ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দিয়েছিল সিআইডি।
পরের বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর অধিকতর তদন্তে আসামির তালিকায় যোগ হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানসহ ৩০ জনের নাম।
এরপর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল দিয়েছিল রায়। তাতে বিচারক বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায়’ ওই হামলা ছিল একটি দলকে ‘নেতৃত্বশূন্য করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা’।
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল, শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ওই হামলা চালানো হয়। হামলায় অংশ নেয় নিষিদ্ধ সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজি) জঙ্গিরা। তারা সহযোগিতা নেয় বিদেশি জঙ্গিদের। হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড আনা হয়েছিল পাকিস্তান থেকে।
এই ষড়যন্ত্রের পেছনে তখনকার চারদলীয় জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ‘ইন্ধন’ ছিল বলে অভিযোগে বলা হয়েছিল।
আদালতে উপস্থাপিত জঙ্গি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানের জবানবন্দিতে বলা হয়, বিএনপি সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের সহায়তায় তিনি আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিলেন। ওই পরিকল্পনা হয়েছিল ‘হাওয়া ভবনে’, যার নিয়ন্ত্রণ ছিল তারেক রহমানের হাতে।
তার ছয় বছর পর অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এলো হাই কোর্টের রায়। তাতে মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। তবে দীর্ঘদিনের আওয়ামী শাসনের অবসানের পর পুনরায় শুরু হয় উক্ত মামলার বিচার কার্য। তবে এ পর্যায়ে অনেকেই নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছে।