ট্রাম্প প্রশাসন আসার আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দিকে সরাসরি অভিযোগের তীর ছুড়ল ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। নরেন্দ্র মোদীর দলের মুখপাত্র সম্বিত পাত্র খোলাখুলিভাবেই বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ভারতকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিজেপির এমন অভিযোগ এটাই প্রথম।
তাদের দাবি, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের একটি দল এবং বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধীর যোগসাজশে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডিপ স্টেট’ মোদীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিজেপির মুখপাত্র সম্বিত বলেন, “এটা সবসময়ই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একটি এজেন্ডা ছিল। তারা ভারতের উন্নয়ন যাত্রায় বাধা সৃষ্টি করার জন্য ভিত্তিহীন অভিযোগ এবং অপপ্রচারমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে।”
বিজেপি বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধেও বিষোদগার করেছে। কারণ রাহুল গান্ধী বিশ্বজুড়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের নেটওয়ার্ক ‘অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট’ (ওসিসিআরপি) এর বিভিন্ন প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে মোদীর সমালোচনা করেন।
বিজেপির অভিযোগ, ওসিসিআরপির প্রতিবেদনগুলোতে মোদী সরকারের সঙ্গে আদানি গ্রুপের ঘনিষ্ঠতার যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তা মনগড়া ও ভিত্তিহীন এর কোনও প্রমাণ নেই।
ওসিসিআরপির প্রতিবেদনে আরও অভিযোগ করা হয়, বিজেপি সরকারের হ্যাকাররা ইসরায়েলের তৈরি পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে তাদের সমালোচকদের কণ্ঠ রোধ করতে চাইছে। তবে বিজেপি সব অভিযোগই অস্বীকার করেছে।
বিজেপির মুখপাত্র ফ্রান্সের সংবাদমাধ্যমের একটি প্রতিবেদনের উল্লেখ করে বলেন, ওসিসিআরপি যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএইড) এবং ‘ডিপ স্টেট’ এর বিভিন্ন ব্যক্তি যেমন জর্জ সোরোসের আর্থিক সহায়তা পায়।
বিজেপি বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রে সরকারে আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়া ‘ডিপ স্টেট’ মোদীর বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে ভারতের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে চায় এবং তাদের এই উদ্দেশ্য স্পষ্ট।
বিজেপির দাবি, ওসিসিআরপি যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডিপ স্টেট’র এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য একটি ‘মিডিয়া টুল’ হিসাবে কাজ করে।
সম্বিত পাত্র বলেন, “একটি ফরাসি অনুসন্ধানী মিডিয়া গ্রুপ প্রকাশ করেছে, ওসিসিআরপির ৫০ শতাংশ তহবিল সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে আসে।”
এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের এক মুখপাত্র বলেছেন, তাদের সরকার সাংবাদিকদের পেশাগত উন্নয়ন এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন সংস্থাকে অর্থ সহায়তা দেয়। তবে কোনও প্রতিষ্ঠানের সম্পাদনা সিদ্ধান্ত বা দিকনির্দেশনাকে প্রভাবিত করে না।
ওই মুখপাত্র বলেন, “ভারতের শাসক দলের পক্ষ থেকে এই ধরনের অভিযোগ করা দুঃখজনক।”
ওসিসিআরপি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা একটি স্বাধীন গণমাধ্যম এবং কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, “যুক্তরাষ্ট্র সরকার কিছু অর্থসহায়তা দিলেও, আমাদের সম্পাদকীয় প্রক্রিয়া এবং প্রতিবেদনের ওপর তাদের কোনও প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ নেই।”
সম্বিত পাত্র রাহুল গান্ধীকেও ‘সর্বোচ্চ পর্যায়ের দেশদ্রোহী’ হিসাবে অভিযুক্ত করেন। তার আরও অভিযোগ, কংগ্রেস ও আমেরিকার কিছু এজেন্সি এবং বিলিয়নিয়ার জর্জ সোরোস মিলে একটি ‘বিপজ্জনক ত্রিমুখী জোট’ তৈরি করেছে, যার উদ্দেশ্য ভারতের স্থিতিশীলতা নষ্ট করা।
সম্বিত পাত্রের অভিযোগটি তার দলের সহকর্মী নিশিকান্ত দুবে পরে ভারতের পার্লামেন্ট লোকসভায়ও তুলে ধরেন। তিনি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ‘বিদেশি শক্তির সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্র’ করার অভিযোগ করেন।
তার দাবি, প্রধানমন্ত্রী মোদীর প্রতি ‘ঘৃণা’ থেকে কংগ্রেস বিজেপি সরকারের অগ্রগতি ব্যাহত করতে চায়।
নিশিকান্ত দুবে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিতর্কিত’ ব্যবসায়ী জর্জ সোরোসের সঙ্গে বৈঠকের জন্য বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু করার আহ্বান জানান। সোরোসকে তিনি ‘নিয়মিতভাবে অন্যান্য দেশের অর্থনীতি ব্যাহত করার ষড়যন্ত্রকারী’ হিসাবে উল্লেখ করেন।
এছাড়া রাহুল গান্ধী আমেরিকান আইনপ্রণেতা ইলহান ওমরের সঙ্গেও গোপন বৈঠক করেছেন বলে দাবি দুবের। ইলহান ওমর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং তার সরকারের তীব্র বিরোধিতা করেন।
দুবে বলেন, “কংগ্রেসকে উত্তর দিতে হবে। রাহুল গান্ধীর বিদেশ সফরে, যারা ভারতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছেন, তাদের সঙ্গে তার কী আলোচনা হয়েছে।”
এর জবাবে কংগ্রেস তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বিজেপির এই অভিযোগকে ‘অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা’ বলে বর্ণনা করেছে। কংগ্রেসের পার্লামেন্ট সদস্য শশী থারুর নিশিকান্ত দুবের এবং তার ‘অগ্রহণযোগ্য মন্তব্যে’রও কঠোরভাবে সমালোচনা করেন।
থারুর বলেন, “প্রথমত, কাউকে মানহানিকরভাবে আক্রমণ করা যায় না। দ্বিতীয়ত, কারও নাম নেওয়ার আগে লিখিত নোটিস দিতে হয়। তৃতীয়ত, সংসদীয় বিশেষাধিকারের অপমান করা যায় না। তিনি এই তিনটি নিয়মই লঙ্ঘন করেছেন এবং তাকে দীর্ঘসময় ধরে কথা বলতে দেওয়া হয়েছে। আমরা এর প্রতিবাদ করেছি। প্রথমে সংসদ মুলতবি করা হয়। পরে আমরা স্পিকারের কাছে গিয়ে বলি, এটি সংসদের রেকর্ড থেকে বাদ দিতে হবে এবং ওই ব্যক্তি ক্ষমা চাইতে হবে।”
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিজেপির এমন অভিযোগ বেশ চমকপ্রদ। কারণ গত দুই দশকে নয়া দিল্লি ও ওয়াশিংটনের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে এবং উভয় দেশ নিজেদের সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তবে সম্প্রতি (গত ২০ নভেম্বর) আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি এবং তার সাত সহযোগীকে যুক্তরাষ্ট্রে ২৬৫ মিলিয়ন ডলারের ঘুষ কেলেঙ্কারি সম্পর্কিত অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। যদিও আদানি গ্রুপ এই অভিযোগগুলোকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছে। এরপর থেকেই ভারতের মোদী সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে।