সুব্রতকে লন্ডনে বড় টার্গেট দিয়েছিলেন আসাদুজ্জামান-জিয়াউল

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশের সময়: শুক্রবার, ৩০ মে, ২০২৫ । ৯:১৯ অপরাহ্ণ

কুষ্টিয়ায় অভিযান পরিচালনা করে সম্প্রতি ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্ট জারি করা শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদকে গ্রেপ্তার করেছে সেনাবাহিনী। কুষ্টিয়া জেলা শহরের কালিশঙ্করপুর এলাকার সোনার বাংলা রোডের বাংলা মসজিদের পাশের একটি বাড়ি থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তারদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা থেকে সুব্রত বাইনের অপর দুই সহযোগী শুটার আরাফাত ও শরীফকেও গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযানে ৫টি বিদেশি পিস্তল, ১০টি ম্যাগাজিন, ৫৩ রাউন্ড অ্যামুনিশন এবং ১টি স্যাটেলাইট ফোন উদ্ধার করা হয়।

এদিকে তাদের গ্রেপ্তারের পর থেকে তাদের নিয়ে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ পেতে শুরু করে। তাদের নিয়ে বৃহস্পতিবার (২৯ মে) লন্ডনে অবস্থানরত আল জাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তার নিজের ভেরিফায়েড প্রোফাইলে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন।

জুলকারনাইন স্ট্যাটাসটি হুবুহু তুলে ধরা হলো-

‘২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্যে বাংলাদেশের ২৩ জন কুখ্যাত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তালিকা তৈরি করা হয় এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শীর্ষ ২৩ জন অপরাধীদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে পুরষ্কার ঘোষণা করে। ওই তালিকার প্রথমেই ছিল ত্রিমোথি সুব্রত বাইন।

তার নামে তখন ১ লক্ষ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে সুব্রত বাইন উপায়ন্তর না দেখে তার সবচেয়ে আস্থাভাজন ও বিশ্বস্ত আরেক পুরস্কার ঘোষিত সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদকে নিয়ে যশোরের পুটখালি সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে যায়। কিন্তু সুব্রত প্রায়ই অবৈধভাবে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে যশোরে আসত চাঁদার টাকা সংগ্রহ করতে এবং বসবাসের জন্যে যশোর শহরের বেজপাড়া এলাকায় স্থানীয় লাল্টুর মাধ্যমে একটি বাসাও তখন ভাড়া নেয়। সুব্রতর দ্বিতীয় স্ত্রী বিউটি, সন্তান নূর, বিথি ও রিপন এখানেই অবস্থান করত, এবং দেশের বিভিন্ন এলাকা হতে মাসিক চাঁদার টাকা আদায়ের পর আবার সীমান্ত পার হয়ে কোলকাতা চলে যেত। এরই মাঝে কোলকাতা পুলিশ সুব্রতকে কালিঘাট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। আটক সুব্রতকে ছাড়াতে নানামুখী তৎপরতা শুরু করে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী তানভিরুল ইসলাম জয়, এবং তার যোগাযোগ ব্যবহার করে সুব্রতকে জেল থেকে মুক্ত করে। তানভীর জয় ছোটবেলায় দার্জিলিংয়ে পড়াশোনার সুবাদে ভারতীয় স্টাবলিশমেন্টে তার কিছু বন্ধু ছিল যারা দেশটির সামরিক বাহিনী, পুলিশ প্রশাসন এবং সরকারী বিভিন্ন কার্যালয় কর্মরত ছিল।’

তিনি আরো উল্লেখ করেন, ‘এ ঘটনার পর জয়, সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদকে ডেকে পাঠান তৎকালীন কোলকাতার পুলিশ কমিশনার এস. কে. চক্রবর্তী। তখন থেকে মূলত এই তিনজনের ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র এবং সেনা গোয়েন্দা এম আই (Military Intelligence)-এর সঙ্গে সম্পর্ক শুরু হয়।

জয় শারীরিকভাবে ফিট না হওয়ায় ‘র এর গোয়েন্দা অফিসাররা সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ ও তাদের সহযোগী গোলাম মর্তুজা বাবু ওরফে মধু বাবুকে ভারতের মধ্যপ্রদেশ ও উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে কমান্ডো প্রশিক্ষণ প্রদান করে নেয়। পরবর্তীতে ‘র এর সিনিয়র কর্মকর্তা এস. মাথুর সুব্রতদের দিল্লি ডেকে নেন এবং বাংলাদেশে লুকিয়ে থাকা ভারতের উলফা, ইউনাইটেড লিবারেশন অফ নাগাল্যান্ডসহ যেসব নিষিদ্ধ সংগঠন আছে সেসব সংগঠনের কিছু নেতাদের ছবি ও ঠিকানা দিয়ে; অস্ত্র অর্থসহ মিশন কার্যকরী করতে যা যা প্রয়োজন সেসবের ব্যবস্থা করে দেয়।’

২০০৩ সালে সব প্রস্তুতি নিয়ে সুব্রত ঢাকায় আসে এবং মোহাম্মদপুর এলাকার একটি বাড়িতে হামলা করে নাগাল্যান্ডের সার্বভৌমত্ব দাবি করা বম সম্প্রদায়ের এক নেতার স্ত্রী ও তার ৭ বছরের সন্তানকে হত্যা করে। এ ছাড়াও পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত মোহাম্মদপুর বিহারী ক্যাম্পের মোস্তাকিম কাবাবের মালিক মোস্তাকিমকে গুলি করে হত্যা করে। মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম) নামের পাকিস্তান ভিত্তিক একটি সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মোস্তাকিম। এ ছাড়াও বহুবার উলফার নেতা পরেশ বড়ুয়াকে হত্যার চেষ্টা করে সুব্রত বাইন।

২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশেষ অনুরোধে কোলকাতায় থাকা সন্ত্রাসীদের আটকের অভিযান শুরু হয়। তখন কোলকাতার সিআইডি কর্মকর্তা রাজিব কুমার, সুব্রত বাইনকে গ্রেপ্তারের জন্যে বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। সুব্রত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরামর্শে ও সহায়তায় আলী মোহাম্মদ নামে একটি ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করে প্রথমে সিঙ্গাপুর, এবং পরে চীনে গিয়ে থিতু হয়। সেখানেও সুব্রত বাইন ‘র এর তত্ত্বাবধানেই ছিল।’

স্ট্যাটাসে আলজাজিরার এ সাংবাদিক আরও লিখেন, ‘‘চীনে ‘র খুব বেশি তৎপর না থাকায় সুব্রত বাইন দুবাই পাড়ি জমায়। সেখানে তাকে বিলাসবহুল ভিলায় থাকার ব‍্যবস্থা করে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এবং তার সহযোগী মোল্লা মাসুদকেও তখন দুবাই পাঠানো হয়। ‘র সুব্রত ও মোল্লা মাসুদকে দুবাইতে পলাতক ভারতীয় মোস্ট ওয়ান্টেড টাইগার মেমনের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপনের পরামর্শ দেয়, তাদের লক্ষ‍্য ছিল টাইগার মেমনের মাধ্যমে কোনোভাবে মাফিয়া সর্দার দাউদ ইব্রাহীমের নেটওয়ার্কে প্রবেশের। কিন্তু এই মিশনে সফল হতে পারেনি সুব্রত বাইন। পরবর্তীতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র এর পরামর্শে সুব্রত বাইন নেপাল হয়ে ভারতে প্রবেশ করে এবং পরিকল্পনা মাফিক কোলকাতায় তার বালিগঞ্জের বাড়ি থেকে STF (Special Task Force) তাকে গ্রেপ্তার করে।

২০২৩ এর ফেব্রুয়ারি মাসে কোলকাতা এসটিএফ (STF) সুব্রতকে প্রেসিডেন্সি জেল থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় বাংলাদেশের সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্ত দিয়ে র‍্যাব (RAB) এর কাছে হস্তান্তর করে। তাকে নিয়ে আসা হয় র‍্যাব সদর দপ্তরে এবং তার সঙ্গে দেখা করেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান ও পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম। সুব্রতকে নতুন লক্ষ্য দেওয়া হয় এবং বলা হয় এই কাজ সফলভাবে করতে পারলে তাকে পরিবারসহ কানাডায় স্থায়ী ভাবে থাকার বন্দোবস্ত করা হবে। সুব্রত প্রস্তাবে রাজী হলে তাকে কুখ‍্যাত জিয়াউল আহসানের তত্ত্বাবধায়নে র‍্যাব কার্যালয়ের ভেতরেই একটি কক্ষে রাখা হয় এবং তার মেয়ে বিতুর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের ব্যবস্থাও করে দেওয়া হয়।

এ সময় সুব্রত বাইনকে জিয়াউল আহসানের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা দূরবর্তী টার্গেটকে লক্ষ্য করে আঘাতের প্রশিক্ষণ প্রদান করে। তাকে স্নাইপার রাইফেল এর ব্যবহার, মুভিং টার্গেটকে গুলি করার আগে বাতাসের গতি, আর্দ্রতা, দূরত্ব এসব খুঁটিনাটি বিষয়ে ট্রেনিং দেওয়া চলতে থাকে।’

তিনি লিখেন, ‘২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সুব্রতর সঙ্গে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, জিয়াউল আহসান, মনিরুল ইসলাম ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা দেখা করে এবং টার্গেট যুক্তরাজ্যে বসবাসরত একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা বলে অবহিত করে। তারা সুব্রতকে পাকিস্তানী পাসপোর্টে লন্ডন পাঠানোর কথা বলে এবং লন্ডনে মিশনটি সম্পন্ন করার জন্যে যা যা সহায়তা লাগবে তা কূটনৈতিক চ‍্যানেলে প্রদান করা হবে বলে সুব্রতকে নিশ্চিত করে।

কাজ হবার পর সুব্রত ও তার পরিবারকে ভারতীয় পাসপোর্টে (আলী মোহাম্মদ নামে) কানাডায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে—এ বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করা হয়। তারা এটাও জানায় এই কাজের ব্যাপারে সরকারের (তৎকালীন) সর্বোচ্চ পর্যায়ের আগ্রহ আছে এবং সর্বোচ্চ মহলের গ্রিন সিগন্যাল পেলেই পাঠানো হবে এবং তার বেশভূষায় যেন পাকিস্তানী বলে মনে হয় এ ব্যাপারেও গুরুত্ব দেওয়া হয়।

কিন্তু ২০২৪ এর ৫ই অগাস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবে হাসিনা সরকার পতন ও হাসিনায় পালানোর পর জিয়াউল আহসানের নির্দেশে সুব্রতকে তার মেয়ে বিথির কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, এবং পরবর্তী আদেশের অপেক্ষার কথা জানানো হয়। এর পর থেকেই সুব্রত বাইন প্রকাশ্যে আসা শুরু করে। পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন করে ‘র এর সাথে। সুব্রতকে সহায়তা করতে বাংলাদেশে স্যাটেলাইট ফোনসহ পাঠানো হয় মোল্লা মাসুদকে। আর এই দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর সাথে পলাতক আওয়ামী শীর্ষ নেতাদের যোগাযোগের মাধ্যম হয় নেপালে পলাতক আরেক সন্ত্রাসী লেদার লিটনকে।”

সম্পাদক: মোঃ শাহ্ আলম খান। বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১০১/বি, (২য় তলা), মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, ঢাকা-১২১৯। মোবাইলঃ +৮৮-০১৬০১-৫৬৩৯৯৯, ফোনঃ +৮৮০২২২৬৬৬৩৯৯১, ইমেইল : infobdnews999@gmail.com, ওয়েব সাইট : www.bdnews999.com

প্রিন্ট করুন