নিরপরাধ পথচারীকে মামলার জালে ফাঁসাতে গিয়ে এবার নিজেই ফেঁসে যাচ্ছেন ভেড়ামারা থানার ওসি শেখ শহিদুল ইসলাম। গত ৬ নভেম্বর রাতে মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগ দেখিয়ে কারসাজি করে নিরীহ পথচারীদের আটক করে। সে-সময় তাদের বৈধ মোটরসাইকেলটি জব্দ করে বৈধ কাগজপত্র অবৈধ বলে মিথ্যা মামলার এজাহারে নামভুক্ত করে জেল হাজতে প্রেরণ করেন ওসি শেখ শহিদুল ইসলাম। যা নিয়ে ১০ নভেম্বর সংবাদ প্রকাশ করা হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। অবশেষে ঘটনার অনুসন্ধানে ভেড়ামারা থানার ৩ অফিসার সহ ওসি নিজেই আটকে গিয়েছেন মিথ্যা বক্তব্যের গেঁড়াকলে।
ঘটনার বিষয়ে ২ নভেম্বর ভেড়ামারা থানা পুলিশ বিভিন্ন গণমাধ্যমকে ব্রিফ করেন। জাতীয় পত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ মোতাবেক ‘বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) ভোররাতে এ ঘটনা ঘটে। আসামিদের শনাক্ত করতে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ চেক করে পুলিশ অভিযান শুরু করে।
প্রকাশিত সংবাদের দিন থানার ওসি প্রায় অর্ধশত গণমাধ্যমে বলেন, “গত ৩১ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার রাত ২টা ৪০ মিনিটের দিকে ভেড়ামারা থানার ভেতরের গ্যারেজ থেকে তিনটি মোটরসাইকেল চুরি করে চোর চক্রের সদস্যরা। ভেড়ামারা থানা পুলিশের এসআই আলামিন, কনস্টেবল সোহেল ও মাসুদ থানার গ্যারেজে মোটরসাইকেল রেখে কাজ করছিলেন। পরে গ্যারেজে ফিরে দেখতে পান মোটরসাইকেল তিনটি নেই। মোটরসাইকেলের ঘাড় লক করা থাকলেও চোরেরা আনলক করে তাদের ১৫০ সিসির বাজাজ পালসার ব্র্যান্ডের তিনটি মোটরসাইকেল নিয়ে যায়।”
ওসি শেখ শহিদুল ইসলাম তখন আরও বলেন, “এ ঘটনায় থানায় একটি চুরির মামলা হয়েছে। মোটরসাইকেল উদ্ধার ও চোর চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করছে পুলিশ। অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
অর্থাৎ থানার ওসির বক্তব্য মোতাবেক ৩১ অক্টোবর থানা থেকে মোটরসাইকেল ৩টি চুরি হলে ২ নভেম্বর থানায় ১টি চুরির মামলা দায়ের হয়। আর সেই অনুযায়ী থানা পুলিশ অভিযান শুরু করে।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, ইত্তেফাক, আজকের পত্রিকা, বাংলাদেশ বুলেটিন, ঢাকা ট্রিবিউন, ঢাকা পোস্ট, সময়ের কন্ঠস্বর, যায়যায় দিন, চ্যানেল ২৪, আরটিভি, সময় টিভি, ডিবিসি নিউজ সহ প্রায় অর্ধশত জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত বক্তব্যের সাথে মামলার এজাহারের তারিখের কোনো মিল নেই।
মূলত ২ তারিখে থানায় কোনো চুরির মামলা না হলেও ওসি গণমাধ্যমে মিথ্যা তথ্য প্রদান করেন। অর্থাৎ প্রকৃত ঘটনা গোপন রেখে ওসি ও পুলিশ সদস্যরা ওঁৎ পেতে ছিলেন কখন নিরীহ পথচারী পাওয়া যাবে এবং তাদের থেকে ফায়দা হাসিল করা যাবে। এটাকে বলা যায়, দায়মুক্তির জন্য উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে নিরীহ মানুষকে ফাঁসানো।
ঘটনার বিষয়ে জানতে ভেড়ামারা থানার ওসি শেখ শহিদুল ইসলামকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘তাদেরকে সন্দেহভাজন হিসেবে ধরা হয়েছে। তারাই যে মোটরসাইকেল চুরি করেছে, আমরা সেটা বলছি না। গণমাধ্যমে আমি বলিনি যে ২ তারিখে মামলা হয়েছে। তারা হয়তো এমনিতেই লিখেছে।’
মূলত গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের তারিখের বিষয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য না দিয়ে এড়িয়ে যান তিনি। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শুভকে ফোন করতে বলেন ওসি।
সেই মোতাবেক ফোন করা হয় এসআই শুভকে। শুরুতে বিষয়টি নিয়ে কিছু বলতে রাজি হননি এসআই শুভ। বারংবার অনুরোধ করলে তিনি বলেন, দেখেন মামলাটি এখনো বিচারাধীন। তদন্তের স্বার্থে আমরা ফোনে কথা বলতে চাচ্ছি না। তাছাড়া যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তারা মোটরসাইকেল চুরি করেছে কি না, সেটা আদালত দেখবে। আমি সাক্ষাতে আপনাদেরকে যতটুকু পারি তথ্য দেয়ার চেষ্টা করবো।’ এই বলে এসআই শুভ ফোন কেটে দেন।
জাতীয় টেলিভিশন, বাঘা বাঘা পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের তারিখের বিষয়ে ওসি কিভাবে অস্বীকার করেন তা জানতে যোগাযোগ করা হয় সংশ্লিষ্ট কিছু গণমাধ্যমে। ওসির বক্তব্যের বিষয়ে গণমাধ্যমগুলো বলেন, ‘গণমাধ্যম হলো একটি জাতির বিবেগ। আমরা কারো বক্তব্য না নিয়ে কখনোই তা লিখবো না। হয়তো ওসি তার কর্মকান্ড এড়িয়ে যেতেই বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। আমরা ওসির সাথে কথা বলেই সংবাদ প্রকাশ করেছি।’
বলা বাহুল্য,
ঘটনার সূত্রপাত গত ৩০ অক্টোবর ভেড়ামারা থানায় ৩টি মোটরসাইকেল চুরিকে কেন্দ্র করে। মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, “৩ জন অজ্ঞাতনামা চোর গত ৩০ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে রাত ৮টা ৫ মিনিটে থানার কম্পাউন্ডের সেডে প্রবেশ করে এবং ৩১ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে রাত ২ টা ৩৯ মিনিটে থানার ৩ টি মটর সাইকেল চুরি করে পালিয়ে যায়।”
অর্থাৎ পুলিশের কারসাজি মোতাবেক, কথিত চোর টানা ৬ ঘন্টা থানায় বিশ্রাম করছিলেন এবং পুলিশ হয়তো নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন। যার কারণে ৬ ঘন্টার মধ্যে কেউই চোরদের দেখেনি।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর অভিযোগ, ‘যেদিন থানা থেকে মোটরসাইকেল চুরি হয় সেদিন পুলিশ কোথায় ছিলো ? চোর যদি ৬ ঘন্টা থানা কম্পাউন্ডের ভেতরে থাকে, তাহলে পুলিশের কেউ দেখলো না ? আর যখন জানাজানি হলো যে, মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে, তখন থানায় কোনো মামলা হলো না কেনো ? তারমানে পুলিশের মাঝে নিশ্চিত সমস্যা আছে। হয়তো তারা চিন্তা করেই রেখেছিল, এই মোটরসাইকেল চুরির ঘটনায় পথচারীদের আটক করে ইচ্ছামতো ঘুষ, জরিমানা আদায় সহ সুবিধামতো ফায়দা হাসিল করা যাবে।’
ঘটনার অনুসন্ধান ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, থানার বাইক হারিয়েছে ৩১ অক্টোবর। আর সেই রেশ ধরে ৩ জনকে আটক করা হয় ৬ নভেম্বর রাত আনুমাকি ১১টা ৪৫ মিনিটে। মূলত ওমর ফারুকের সাথে থাকা তার নিজস্ব ১৫০ সিসির নিবন্ধিত পালসার মোটরসাইকেলটিকে অনিবন্ধিত বলে চুরির অভিযোগ দেয়। এমনকি মামলার এজাহারে তার নিবন্ধিত বৈধ মোটরসাইকেল অবৈধ বলে জব্দ করে এবং মোটরসাইকেল চোর চক্রের সদস্য বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া হয়। পরবর্তীতে ৭ নভেম্বর কোনোপ্রকার তদন্ত ছাড়াই ওমর ফারুক, জামিল খান এবং হৃদয়কে উক্ত মামলায় ফাঁসানো হয়। তাদের পরিবারকে কোনো কিছু জানতে না দিয়ে তাদেরকে থানায় জিম্মি করে রেখে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল হাজতে প্রেরণ করে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, মোঃ ওমর ফারুক (২৯) বাড়িতে মুরগীর খামাড় দেখাশোনা করে। গত ৬ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে তার নিজস্ব রেজিষ্ট্রেশন করা একটি ১৫০ সিসির পালসার বাইক নিয়ে ভেড়ামারায় যান অন্যান্য মুরগির খামারে ভ্যাকসিন দিতে। কাজ শেষ করতে রাত হলে ওমর ফারুক তার ২জন বন্ধুর সহায়তা নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করে। আনুমানিক রাত ১১ টা ৪৫ এর সময় পুলিশ তাদের ২ জন বন্ধু সহ বাইক আটক করে এবং রেজিষ্ট্রেশন করা বাইক টি রেজিষ্ট্রেশন বিহীন বলে থানায় জব্দ করে। এরপর মোটর সাইকেল চুরির মামলায় অজ্ঞাত নামা আসামি করে কৌর্টে চালান করে।
গোপন সূত্রে আরো জানা যায়, আটক করার পর এএসআই আল আমিন অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে এবং এএসআই এনামুল একজনকে মারপিট শুরু করে। এরপর থানার মটরসাইকেল চুরির মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মোবাবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে মারতে মারতে ওমর ফারুক সহ সবাইকে থানায় নিয়ে যায়। সেখানে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে পরিবারের কারো সাথে যোগাযোগ না করে একপ্রকার জিম্মি করে রাখে তাদেরকে।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একজন অভিযোগ করেন, “এএসআই আলামিন বলে ‘আমাদের চুরি হওয়া মটরসাইকেলের দাম ৬,০০,০০০ (ছয় লক্ষ) টাকা দিয়ে দে। তাহলে তোকে এবং তোদের কে ছেড়ে দিবো। মূলত এএসআই আলামিনকে টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আলামিন এবং এএসআই এনামুল বলে শালাদের মামলা দিয়ে শুভ (এসআই শুভ মামলার তদন্তকারী অফিসার) কে দিয়ে রিমান্ডে নিয়ে এসে মারপিট করলেই টাকা এবং গাড়িও পাওয়া যাবে।”
আটককৃতদের এক ভাই বলেন, “যেহেতু থানার মটর সাইকেল চুরির সিসি ফুটেজ আছে। সেহেতু প্রকৃত চোর না ধরে অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্যই মিথ্যা মামলা দিয়ে আমার নিরিহ ভাইকে এসআই শুভ (মামলার তদন্তকারী অফিসার) রিমান্ডের হুমকি দিয়ে জেল হাজতে প্রেরন করে এবং আমার ভাইয়ের বৈধ মটর সাইকেলটি চুরির মটর মাইকেল বলে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধমে ছড়িয়ে দেয়। পরর্বতীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দিয়েই আমি আমার ছোট ভাইয়ের সন্ধান পাই। মূলত আমার ছোট ভাই মোঃ ওমর ফারুক ভেড়ামারা বিভিন্ন মুরগির খামাড়ে ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য এবং মুরগি দেখাশোনার জন্য যায় এবং ফিরতে রাত হলে তার বন্ধুদের সহযোগিতা নেয়। পরে রাস্তায় তাদের আটক করে উল্লেখিত অফিসারেরা এই এঘটনা ঘটায়। তাছাড়া সিসিটিভি ফুটেজ অনুযায়ী উক্ত মিথ্যা মামলার কোনপ্রকার মিল নেই।”
এবিষয়ে জানতে ভ্যাকসিন দিতে যাওয়া এলাকার বিভিন্ন খামারিদের সাথে কথা হয় গণমাধ্যম কর্মীদের। তারা বলেন, “ওমর ফারুক নিয়মিতই আমাদের এলাকায় মুরগির খামারে ভ্যাকসিন দিতে আসে। অনেক সময় রাত হলে তার পরিচিত বা বন্ধুদের নিয়ে বাসায় ফিরে। তাছাড়া তার নিজেরই একটা পালসার বাইক আছে। এটা করেই ফারুক নিয়মিত যাতায়াত করে। সেখানে অন্যের বাইক চুরির প্রশ্নই ওঠে না। পুলিশ তাদেরকে কেনো আটক করলো এবং কেনো মামলা দিয়ে জেলে পাঠালো তা আমাদের মাথায় ঢুকছে না।”
খামারিরা অভিযোগ করে বলেন, “খবর শুনে আমরা থানায় যায় এবং ওসি মহোদয়ের সাথে কথা বলি। আমরা বিস্তারিত বলে ওসি সাহেবকে বোঝায় যে, ওমর ফারুক নিয়মিত এই ভ্যাকসিনের কাজ করে এবং প্রায়শই তার ফিরতে রাত হয়। তাছাড়া এই মোটরসাইকেলও ওমর ফারুকের। তাই বাইকের কাগজপত্র যাচাই করে তাদেরকে ছেড়ে দিন। কিন্তু ওসি সাহেব মোটরসাইকেলের কাগজপত্র চেক না করেই বলেন এটা চোরাই, অবৈধ এবং রেজিষ্ট্রেশন বিহীন গাড়ি। আমরা তাদেরকে আটক করেছি, এখন ছাড়বো না। আগামীকাল আদালতে গিয়ে তাদেরকে ছাড়িয়ে আনবেন।”