সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলো রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। অর্থাৎ এই নামে বাংলাদেশে আর রাজনীতি করা যাবে না। সোমবার এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠকে শনিবার রাতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুসারে-আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনে দলটির বিচার হবে। এই বিচারের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এবং তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকবে।
প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় রাত ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে যমুনার সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। এ সময়ে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন।
আসিফ নজরুল বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় তিনটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদন হয়েছে। সংশোধনী অনুযায়ী এই ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, দলের অঙ্গ সংগঠন, সমর্থক সংগঠন বা তার নেতাকর্মীকে শাস্তি দিতে পারবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচার কাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা এবং অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরিপত্র পরবর্তী কর্মদিবসে জারি করা হবে। পাশাপাশি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জুলাই ঘোষণাপত্র আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে চূড়ান্ত করে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে দেশ। গত ৭ মে রাত ১০টার পর এই আন্দোলনের সূচনা হয়। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর ডাকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে জড়ো হতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা। রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পালটে যায় দৃশ্যপট। ধীরে ধীরে আসতে থাকেন এনসিপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী ছাত্রশিবির, গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের নেতাকর্মীরা। মাঠে নামে শাপলা চত্বর ও পিলখানা হত্যাকাণ্ডের শিকার পরিবারের সদস্যসহ আহত জুলাই যোদ্ধারাও।
বৃহস্পতিবার রাতভর বিক্ষোভ চলার পর শুক্রবার বাদ জুমা যমুনার পাশে ফোয়ারার সামনে বড় জমায়েত হয়। ডাক আসে শাহবাগ ব্লকেডের। এদিন রাজধানীর উত্তরাসহ ঢাকার কিছু প্রবেশমুখে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। বিভাগীয় শহর কিংবা জেলা-উপজেলায়ও ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে তারাও সমানতালে নামেন সড়কে। সিদ্ধান্ত না এলে এরই মধ্যে ফের ‘মার্চ টু ঢাকা’র হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এনসপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। একইসঙ্গে তিন দফা দাবিতে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছে জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, ‘রাজনৈতিক সব দলের সঙ্গে এরই মধ্যে যোগাযোগ করেছে সরকার। তাদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতা-সমর্থকদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদন সরকার বিবেচনায় রাখছে।’ তবে পুরোপুরি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত ময়দান না ছাড়ার ঘোষণা দেয় বিক্ষোভকারীরা।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০০৯ সাল থেকে ১৬ বছরের শাসনামলে অনিয়ম-গণহত্যা, গুম-খুন, নির্যাতন, অর্থ বাণিজ্যসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অপরাধ করেছে আওয়ামী লীগ। দলটির সভানেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সরাসরি অভিযুক্ত করা হয়েছে এ রিপোর্টে। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে তিনটি জাতীয় নির্বাচন জালিয়াতি করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল টিকিয়ে রাখেন শেখ হাসিনা। আর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে এমন কোনো অপরাধ নেই, যা করেননি তিনি। বেপরোয়া অপরাধ ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে দেশের মানুষ। এরপর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান হাসিনা। এ সময়ে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয় তার দল আওয়ামী লীগ। এরপর আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। তবে জাতিসংঘের রিপোর্টে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ না করার সুপারিশ করা হয়েছে।
শনিবার বিকালে শাহবাগ থেকে ফ্যাসিবাদের কফিনে শেষ পেরেক মারার অঙ্গীকারের কথা জানিয়েছেন, এনসিপিসহ জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতারা। শনিবার বিকালে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করাসহ তিন দফা দাবিতে ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যের ব্যানারে গণজমায়েত কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নিয়ে তারা এই অঙ্গীকারের কথা জানান। তারা বলেন, আমাদের এই লড়াই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশপন্থিদের লড়াই। এ সময় আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত মাঠে থাকা এবং দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে সরকারের প্রতিও অনাস্থা দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন বক্তারা।
অবশেষে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়।
আপনার মতামত লিখুন