ইসরায়েলের সিসি ক্যামেরা হ্যাক করছে ইরান

ইসরায়েলের বেসরকারি সিসিটিভি ব্যবস্থা হ্যাক করে তাৎক্ষণিক গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করছে ইরান। এমনই হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন ইসরায়েলের সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। এই কৌশল আগেও হামাস ও রাশিয়া বিভিন্ন সংঘাতে ব্যবহার করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী দ্রুত সম্প্রসারিত হওয়া ব্যক্তিগত নজরদারি বাজারে ব্যবহৃত অনেক ক্যামেরা দুর্বল পাসওয়ার্ড, পুরোনো ফার্মওয়্যার এবং ভুল ইনস্টলেশনের কারণে সহজেই হ্যাক করা যায়।
গত সপ্তাহে ইরানি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তেল আবিবের উঁচু ভবনগুলোতে আঘাত হানে। এরপর সরকারি রেডিওতে নাগরিকদের সতর্ক করে ইসরায়েলের জাতীয় সাইবার ডিরেক্টরেটের সাবেক উপপরিচালক রাফায়েল ফ্রাঙ্কো বলেন, ‘গত দুই-তিন দিন ধরে ক্যামেরাগুলোর মাধ্যমে ক্ষেপণাস্ত্র কোথায় আঘাত হেনেছে তা জানার চেষ্টা করছে ইরান, যাতে ভবিষ্যতে আরও নির্ভুলভাবে হামলা করা যায়। তাই আপনারা ক্যামেরা বন্ধ করুন অথবা পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করুন।’
উল্লেখ্য, ফ্রাঙ্কো বর্তমানে সাইবার নিরাপত্তা সংস্থা কোড ব্লু পরিচালনা করছেন।
ইসরায়েল ও ইরানের চলমান সংঘাতের মধ্যে সাইবার আক্রমণের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। ইসরায়েলপন্থী হ্যাকার গ্রুপ ‘প্রিডেটরি স্প্যারো’ ইরানের একটি প্রধান ব্যাংক ও একটি ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জে সাইবার আক্রমণের দায় স্বীকার করেছে। অন্যদিকে, ইরানের রাষ্ট্রীয় মিডিয়া জানিয়েছে, ইসরায়েল দেশটির গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোয় পূর্ণাঙ্গ সাইবার আক্রমণ চালিয়েছে।
ইসরায়েলের জাতীয় সাইবার ডিরেক্টরেটের এক মুখপাত্র জানান, ‘যুদ্ধ পরিকল্পনায় ইরান বারবার ব্যবহার করছে ইন্টারনেট সংযুক্ত ক্যামেরা। আমরা দেখেছি, যুদ্ধ চলাকালীন এই ধরনের প্রচেষ্টা বাড়ছে।’
হামাস এর আগেও এই কৌশল ব্যবহার করেছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামলার আগে গাজা সীমান্তবর্তী ইসরায়েলি এলাকায় থাকা হাজার হাজার ব্যক্তিগত ও সরকারি ক্যামেরা হ্যাক করে হামাস বিশাল তথ্য সংগ্রহ করে বলে জানান সাইবার ডিরেক্টরেটের সদ্য সাবেক পরিচালক গ্যাবি পোর্টনয়।
তিনি আরও জানান, ‘হামাসের গোয়েন্দা সংগ্রহ ছিল বিপর্যয়কর। তাদের হামলার প্রস্তুতিতে এগুলোর ভূমিকা ছিল স্পষ্ট।’
রাশিয়াও ইউক্রেন আক্রমণের পর এই পদ্ধতি ব্যবহার করেছে বলে জানা গেছে। গত মে মাসে এক যৌথ বিজ্ঞপ্তিতে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানায়, রাশিয়া সীমান্ত, সামরিক স্থাপনা ও রেলস্টেশনের কাছে থাকা বেসরকারি ক্যামেরায় প্রবেশ করে গুরুত্বপূর্ণ চলাচল পর্যবেক্ষণ করেছে। এমনকি ট্রাফিক ক্যামেরাও ব্যবহার করেছে তারা।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ইউক্রেন ২০২২ সালে সিসিটিভি নিষিদ্ধ করে। পরে নাগরিকদের ওয়েবক্যামের অনলাইন সম্প্রচার বন্ধের আহ্বান জানায় সরকার। এক বিবৃতিতে তারা জানায়, ‘রাশিয়া ওয়েবক্যামের দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার লক্ষ্য ঠিক করছে।’
২০২২ সালে জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগে চীনের তৈরি নজরদারি যন্ত্র নিষিদ্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
বিশ্বব্যাপী বেসরকারি নজরদারি ক্যামেরার বাজার ২০২৪ সালে ৫৪ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০৩০ সালে ৮৯ বিলিয়নে পৌঁছাতে পারে বলে জানিয়েছে মার্কেটসঅ্যান্ডমার্কেটস রিসার্চ।
তবে অনেক ক্যামেরা নিরাপত্তা এতটাই দুর্বল যে, সেগুলো বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।
নিরাপত্তা খাতে কাজ করা জিওফ কোল জানান, ভালো কোম্পানির ক্যামেরাগুলো সফটওয়্যার আপডেট ও কনফিগারেশন অপশন দেয়। তবে ব্যবহারকারীদের নিজে থেকেই ধরে নিতে হবে যে, তাদের ভিডিও সিস্টেম লক্ষ্যবস্তু হতে পারে।
বিশ্বখ্যাত এক জ্বালানি কোম্পানির নিরাপত্তা স্থপতি পেলেগ ভাসারম্যান বলেন, ‘ভোক্তারা সস্তা দামে নজরদারি ক্যামেরা কিনে থাকেন, তবে নিরাপত্তার দিকটা বিবেচনায় নেন না। ফলে নির্মাতাদেরও সুরক্ষা বাড়াতে কোনো প্রণোদনা থাকে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘কেউ জানে না, তারা যেটা রক্ষা করতে চাইছে, সেটাই অন্যের নজরে তুলে ধরছে।’
এ ছাড়া, অনেক ক্যামেরার ডিফল্ট পাসওয়ার্ড ‘১-২-৩-৪’-এর মতো সহজ, যা অনেক ব্যবহারকারী পরিবর্তন করেন না। কিছু সিস্টেম এমনকি স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনলাইনে ভিডিও স্ট্রিম করে।
চীনা কোম্পানিগুলোর তৈরি ক্যামেরা বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হলেও এগুলোতে নিরাপত্তা দুর্বলতা থাকায় উদ্বেগ বাড়ছে। এক প্রতিবেদনে সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান বিটসাইট জানায়, গত মাসে ইন্টারনেটে ৪০ হাজার সিসিটিভির লাইভ ফুটেজ দেখা গেছে, যার ১৪ হাজার যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত।
যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে এসব ফুটেজ দেশের জন্য বড় দুর্বলতায় পরিণত হতে পারে।
২০২২ সালে ইসরায়েলি সাইবার সংস্থা জানিয়েছিল, ৬৬ হাজার ক্যামেরা ডিফল্ট পাসওয়ার্ড ব্যবহার করছে। তবে অনেক ব্যবহারকারী তা আমলে নেননি। দক্ষিণ ইসরায়েলের হামাস আক্রমণের শিকার শহরগুলোতেও এসব ক্যামেরা ব্যবহৃত হচ্ছিল।
হামলার পর সরকার কিছু নির্দেশনা দেয়, যার মধ্যে ছিল পাসওয়ার্ড পরিবর্তন, দুই স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা এবং চীনের তৈরি ক্যামেরা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা। এমনকি ট্রাফিক ক্যামেরা ও ব্যক্তিগত ডিভাইস, যেগুলো সেনা ঘাঁটি বা সীমান্তে দৃশ্য দেখাচ্ছিল তা বন্ধ করে দেওয়ার আইনি অনুমতিও পাওয়া হয়।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের আগে এক সাক্ষাৎকারে ফ্রাঙ্কো জানান, সীমান্তঘেঁষা ফার্মে কৃষকদের বসানো ক্যামেরাগুলোও সেনা অবস্থান দেখিয়ে ফেলেছিল।
গত ১৩ জুন (শুক্রবার) ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পর ইরান পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে তেল আবিবে শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছোড়ে। ইরান জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় তাদের ২০০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছে। ইসরায়েলে এখন পর্যন্ত ২৪ জন নিহত ও ৮০০-এর বেশি মানুষ আহত হয়েছে বলে সরকারি সূত্রে জানা গেছে।
তথ্যসূত্র: ব্লুমবার্গ।
আপনার মতামত লিখুন