শান্তিকামী ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করতে হবে। পবিত্র পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী ভূমি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বাধ্যবাধকতা তৈরি; গণহত্যা বন্ধে কার্যকর ও সম্মিলিত পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া জায়নবাদী বর্বর ইসরায়েলের গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছে ঐতিহাসিকভাবে।
আজ শনিবার (১২ এপ্রিল) বিকেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট’ আয়োজিত ‘মার্চ ফর গাজা’ সমাবেশে এসব দাবির কথা জানানো হয়েছে। ঘোষণাপত্রে এসব দাবির কথা জানান আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
ঐতিহাসিক এই ঘোষণাপত্র ও অঙ্গীকারনামায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, মুসলিম উম্মাহ, বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের প্রতি চার স্তরে তাঁদের দাবি ও অবস্থান তুলে ধরা হয়।
দখলদার ইসরায়েলের গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে নিশ্চিত করতে হবে জানিয়ে ঘোষণাপত্র ও অঙ্গীকারনামায় মাহমুদুর রহমান বলেন, ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করতে হবে; কারণ, এই মুহূর্তে বিশ্বব্যবস্থা যে ন্যায়ের মুখোশ পরে আছে, গাজার ধ্বংসস্তূপে সেই মুখোশ খসে পড়েছে।

জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘যেহেতু জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সব জাতির অধিকার রক্ষার, দখলদারত্ব ও গণহত্যা রোধের সংকল্প প্রকাশ করে এবং আমরা দেখেছি, গাজায় প্রতিদিন যে রক্তপাত, যে ধ্বংস চলছে, তা কোনো একক সরকারের ব্যর্থতা নয়, বরং এটি একটি আন্তর্জাতিক ব্যর্থতার ফল এবং এই ব্যর্থতা শুধু নীরবতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং পশ্চিমা শক্তিবলয়ের অনেক রাষ্ট্র সরাসরি দখলদার ইসরায়েলকে অস্ত্র, অর্থ ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে এই গণহত্যাকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে। এই বিশ্বব্যবস্থা দখলদার ইসরায়েলকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে বরং রক্ষা করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।’
বর্বর ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সব সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানিয়ে মুসলিম উম্মাহর নেতাদের উদ্দেশে ঘোষণাপত্রে বলা হয়, জায়নবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে; গাজার জনগণের পাশে চিকিৎসা, খাদ্য, আবাসন, প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ সর্বাত্মক সহযোগিতা নিয়ে দাঁড়াতে হবে; আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসরায়েলকে একঘরে করতে সক্রিয় কূটনৈতিক অভিযান শুরু করতে হবে এবং জায়নবাদের দোসর ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসনের অধীনে মুসলিমদের অধিকার হরণ; বিশেষ করে, ওয়াক্ফ আইনে হস্তক্ষেপের মতো রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ওআইসি ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে দৃঢ় প্রতিবাদ ও কার্যকর কূটনৈতিক অবস্থান নিতে হবে।
এদিনের সমাবেশ থেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বাংলাদেশি পাসপোর্টে ‘Except Israel’ শর্ত পুনর্বহাল; ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পাদিত সব চুক্তি বাতিল, রাষ্ট্রীয়ভাবে গাজায় ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা পাঠানো; জায়নবাদী কোম্পানির পণ্য বর্জনের নির্দেশনা দিতে আহ্বান জানানো হয়।
এ ছাড়া ভারতের কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদী সরকারের অধীনে মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান নির্যাতনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবাদ এবং পাঠ্যবই ও শিক্ষানীতিতে আল-আকসা, ফিলিস্তিন ও মুসলিমদের সংগ্রামী ইতিহাসকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে জোরালো আহ্বান জানানো হয়।
সমাবেশে অঙ্গীকারনামায় মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘আমরা সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বয়কট করব সেই পণ্য, কোম্পানি ও শক্তিকে—যারা ইসরায়েলের দখলদারত্বকে টিকিয়ে রাখে। আমরা আমাদের সমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রস্তুত করব—যারা ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর সব প্রতীক ও নিদর্শনকে সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার করবে।’
মাহমুদুর রহমান আরও বলেন, ‘আমরা আমাদের সন্তানদের এমনভাবে গড়ে তুলব, যারা নিজেদের আদর্শ ও ভূখণ্ড রক্ষায় জান ও মালের সর্বোচ্চ ত্যাগে প্রস্তুত থাকবে; আমরা বিভাজিত হব না। কারণ, আমরা জানি, বিভক্ত জনগণকে দখল করতে দেরি হয় না।’ এ ছাড়া বাংলাদেশ কখনো কোনো হিন্দুত্ববাদী প্রকল্প পরবর্তী গাজায় যাতে পরিণত না হয়, সে জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান তিনি।

স্বাধীনতাকামী গাজার সাহসী জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে সমাবেশ থেকে বলা হয়, ‘আপনারা ইমান, সবর আর কোরবানির মহাকাব্য রচনা করেছেন। দুনিয়াকে দেখিয়েছেন, ঈমান আর তাওয়াক্কুলের শক্তি আমরা, বাংলাদেশের মানুষ শাহজালাল আর শরীয়তুল্লাহর ভূমি থেকে আপনাদের শহীদদের প্রতি ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা জানাই। হে আল্লাহ, গাজার এই সাহসী জনপদকে তুমি সেই পাথর বানিয়ে দাও, যার ওপর গিয়ে ভেঙে পড়বে জায়োনিস্টদের সব ষড়যন্ত্র।’
“মার্চ ফর গাজা” সমাবেশের অন্যতম আয়োজক আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, ‘বাংলাদেশের সব দল, মত, চিন্তা-দর্শনের মানুষ মজলুম ফিলিস্তিন ও মজলুম গাজার পাশে আছে, সহাবস্থান করছে। এক কাতারে দাঁড়িয়ে আজ বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিতে চাই, আমাদের মধ্যে বিভিন্ন চিন্তা, মতগত পার্থক্য, ভিন্নতা থাকতে পারে; কিন্তু মজলুম ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা, ভূমির অধিকারের দাবিতে আমরা বাংলাদেশের মানুষ ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে প্রত্যেকে তাঁদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছি।’
শুরু থেকেই ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের সতেজ রাখার অগ্রনায়ক, বিশিষ্ট আলেম ও স্বনামধন্য ধর্মীয় আলোচক ড. মিজানুর রহমান আজহারী বলেন, ‘আজকের এই মহাসমুদ্র, জনসমুদ্র ফিলিস্তিনের প্রতি, আল-আকসার প্রতি বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। ভৌগোলিকভাবে আমরা ফিলিস্তিন থেকে অনেক দূরে হতে পারি, কিন্তু আজকের এই জনসমুদ্র প্রমাণ করে আমাদের হৃদয়ে বাস করে একেকটা ফিলিস্তিন, আমাদের হৃদয়ে বাস করে একেকটা গাজা, আমাদের হৃদয়ে বাস করে একেকটা আল-কুদস।’
সবশেষ ফিলিস্তিনের জনগণের জন্য দোয়া করে মোনাজাত পরিচালনা করেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ আব্দুল মালেক। বিকেল ৪টা নাগাদ সমাবেশের সমাপ্তি ঘোষণা করেন তিনি।
এদিনের ঐতিহাসিক সমাবেশে সংহতি জানিয়ে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিঞা গোলাম পরওয়ার, জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মামুনুল হক, বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার ও বক্তা মিজানুর রহমান আজহারী, বিশিষ্ট আলেম শায়খ আহমাদুল্লাহ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির ফয়জুল করীম, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর সহ অনেক।
আপনার মতামত লিখুন