অভিযোগ, বিতর্ক, বর্থতা ছিলো তাদের সঙ্গী
বিতর্কিত দুদক চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনারের পদত্যাগপত্র গৃহীত
ছাত্র-জনতার গনঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রায় ৩ মাস পর গত মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনার পদত্যাগ করেন। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাদের পদত্যাগপত্রগুলো গৃহীত হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। প্রজ্ঞাপনে সই করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ (২০০৪ সনের ৫নং আইন) এর ১০(১) নং ধারা অনুযায়ী দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনার মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ এবং কমিশনার জহুরুল হক ও কমিশনার মোছা. আছিয়া খাতুন পদত্যাগ করেছেন। ৩১ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাদের পদত্যাগপত্রগুলো গৃহীত হয়েছে।’
জানা যায়, চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ ও দুই কমিশনার ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগ করার আগে মঙ্গলবার সকালে প্রতিদিনের মতো অফিসে গিয়ে তারা দাপ্তরিক কাজ সারেন। ওইদিন বিকেলে তাদের দুদক সংস্কার কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করার কথা ছিল। কিন্তু দুপুর ১টার দিকে সংস্কার কমিশনের বৈঠক স্থগিতের খবর আসে কমিশনে। কার্যত এর পরই তারা পদত্যাগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন।
পরিচয় গোপন রেখে দেশের শীর্ষস্থানীয় এক গণমাধ্যমে দুদকের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনার তাদের পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়ে অনেকটা নীরবে দুদক কার্যালয় ত্যাগ করেন। এ সময় সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন তাদের এগিয়ে দেন। বিকাল সাড়ে তিনটায় দুর্নীতি দমন কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় অংশ নিতে আসার কথা ছিল দুদক সংস্কার কমিশনের।’
তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ৩ মার্চ মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহকে দুদকের চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়। তিনি ইকবাল মাহমুদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। ওই সময় তার সঙ্গে জহুরুল হককে কমিশনার (তদন্ত) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এর দেড় বছর পর কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান অবসরে গেলে নিয়োগ পেয়েছিলেন আছিয়া খাতুন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। এরপর প্রশাসনিক হেডকোয়ার্টার হিসাবে পরিচিত সচিবালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে থাকা স্বৈরশাসকের দোসরদের বিদায় ঘণ্টা বাজতে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় পতিত সরকারের আজ্ঞাবহ হিসাবে পরিচিত দুদক চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনারকে সরিয়ে দেওয়াসহ দুদক ঢেলে সাজানোর দাবি ওঠে। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সমন্বয়করাও সম্প্রতি দুদকে গিয়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে সংস্থাটির ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। দুদক সংস্কারে সরকার গঠন করে কমিশন। তখন সরকারের আস্থা অর্জনে দুদক শতাধিক সাবেক মন্ত্রী-এমপি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু দুদকের এসব কাজ লোক দেখানো বলে মন্তব্য করতে থাকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দুদকের কাজের সমালোচনা করে সংস্থাটিকে ঢেলে সাজানোর তাগিদ দেন। দুদকের বিতর্কিত কাজ ও দায়সারা ভূমিকা নিয়ে যুগান্তর, বাংলা খবর প্রতিদিন, বিডিনিউজ ট্রিপল নাইন সহ একাধিক পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। নানা বিতর্কের মুখে অবশেষে মঙ্গলবার পদত্যাগ করলেন দুদক চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি গণমাধ্যমে জানান, দুদক চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনারের পদে নতুন মুখ নিয়োগ দিতে শিগগিরই সার্চ কমিটি গঠন করা হবে। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে নতুন কমিশন। তবে সার্চ কমিটি কাজে স্বচ্ছতা দাবি করেছেন দুদক কর্মকর্তারা। তাদের অভিযোগ-আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সার্চ কমিটির কাজে স্বচ্ছতা ছিল না।
উদাহরণস্বরূপ এক কর্মকর্তা বলেন, সার্চ কমিটির তালিকায় বিদায়ি চেয়ারম্যান ও একজন কমিশনারের নাম ছিল না। সার্চ কমিটির তালিকা প্রকাশও করা হয়নি। সরকারের পছন্দের ব্যক্তিদের রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়েছেন। কিন্তু এবার যে সার্চ কমিটি গঠন করা হবে তাদের সুপারিশ করা নামের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। এরপর সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগ দিতে হবে।
তাছাড়া চেয়ারম্যান ও কমিশনার হিসাবে যারা নিয়োগ পাবেন তারা আসলে দুর্নীতি প্রতিরোধে কী করতে চান তার একটি পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে। এছাড়া কমিশনের অনুপস্থিতিতে দুদকের কাজ কীভাবে চলবে সে বিষয়ে আইনি শূন্যতা রয়েছে। তা দূর করতে হবে।
দীর্ঘদিন ধরেই দুদকের ভেতর-বাইরে আলোচনা আছে, পতিত সরকারের আজ্ঞাবহ হিসাবে মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ কমিশন নানা ঘটনায় দুদককে বিতর্কিত করেছেন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ইশারায় বিদায়ি কমিশন বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তার বিরুদ্ধে আরও মামলা দেওয়ার প্রস্তুতি চূড়ান্ত করা হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ পটপরিবর্তনে সেটা করতে পারেনি।
আবার সরকারের ইশারা ও উচ্চ আদালতের চাপে কমিশন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করলেও প্রশাসন ও দুদকের সহায়তায় তিনি দেশত্যাগ করেন। কমিশনের অবহেলায় অনুসন্ধান চলাকালে ব্যাংক থেকে ১৩ কোটি টাকা তুলে নেন বেনজীর। এ ধরনের স্পর্শকাতর দুর্নীতির অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা ও ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি।
তাছাড়া বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের ব্যাংক থেকে ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচারের ঘটনা অনুসন্ধান করার সাহসই করেনি কমিশন। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুনী জাভেদ ও তার স্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও দুবাইয়ে বিপুল সম্পদের তথ্য থাকার পরও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর বাইরেও পতিত সরকারের চামচা খ্যাত বিতর্কিত দুদক চেয়ারম্যান ও কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগ ও ব্যর্থতার দায় নিয়েই বিদায় নিলেন চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনার।
আপনার মতামত লিখুন