সেনাপ্রধানের কার্যালয় থেকে সরানো পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের ছবি ঠাঁই হলো যেখানে
১৯৭১ সালের ১৬-ই ডিসেম্বর, যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। যার মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের সেই স্থিরচিত্রটি এত দিন টাঙানো ছিল ভারতের সেনাপ্রধানের কার্যলয়ের লাউঞ্জে। তবে সম্প্রতি সেই ছবিটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। যা নিয়ে তৈরি হয়েছে ব্যাপক বিতর্ক।
এ নিয়ে দেশটির পার্লামেন্টে বির্তক শুরু হলে জানা যায়, ছবিটি সেনাপ্রধানের কার্যলয় থেকে সরিয়ে মানেকশ কনভেনশন সেন্টারে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুর প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি সেনাপ্রধানের লাউঞ্জ থেকে সরিয়ে নেওয়া ১৯৭১ সালের পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক চিত্রটি ভারতীয় সেনাবাহিনী গতকাল সোমবার মানেকশ কনভেনশন সেন্টারে পুনঃস্থাপন করেছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিশিয়াল এক্স হ্যান্ডেলের শেয়ার করা এক পোস্টে বলা হয়েছে, ‘বিজয় দিবসের দিনে সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী এবং আর্মি ওয়াইভস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মিসেস সুনীতা দ্বিবেদী ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণের চিত্রটি মানে কশ সেন্টারে পুনঃস্থাপন করেছেন। এই কেন্দ্রটির নামকরণ করা হয়েছে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের প্রধান স্থপতি এবং বীর ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশর নামে।’ এ সময় অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ও প্রবীণ সেনাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
চিত্রটিকে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর অন্যতম বড় সামরিক বিজয় এবং ন্যায়বিচার ও মানবিকতার প্রতি ভারতের অঙ্গীকারের স্মারক হিসেবে তুলে ধরে সেনাবাহিনী জানিয়েছে, ‘মানেকশ সেন্টারে এটি স্থাপন করার ফলে এই স্থানে ভারত এবং বিদেশ থেকে আগত বিভিন্ন দর্শক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জন্য এর তাৎপর্য আরও প্রসারিত হবে।’
অর্ধশতাব্দী ধরে ভারতীয়দের কাছে ‘সবচেয়ে বড় সামরিক বিজয়ের’ প্রাণবন্ত প্রতীক ছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের নথিতে স্বাক্ষরের একটি ছবি। সম্প্রতি ছবিটি সেনাপ্রধানের কার্যালয় থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। ছবিটি পাঁচ দশক ধরে সেনাপ্রধানের কার্যালয়ে ঝুলে ছিল এবং প্রায়ই বিদেশি জেনারেল ও অন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তোলা ছবির পটভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া ও দ্য হিন্দুর খবরে বলা হয়েছে, সেনাপ্রধানের লাউঞ্জে নতুন একটি চিত্রকর্ম স্থাপন করা হয়েছে। এই নতুন চিত্রকর্ম ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দৃশ্য তুলে ধরা ঐতিহাসিক চিত্রকর্মের জায়গায় প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
সেনাবাহিনীর একটি সূত্র দ্য হিন্দুকে জানায়, নতুন চিত্রকর্মটির নাম হিন্দি ও ইংরেজিতে ‘করম ক্ষেত্র—ফিল্ড অব ডিডস’। এই চিত্রকর্ম ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২৮ মাদ্রাজ রেজিমেন্টের কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল থমাস জ্যাকব এঁকেছেন। এতে সেনাবাহিনীকে ‘কেবল জাতির প্রতিরক্ষা নয়, এর পাশাপাশি ধর্মের রক্ষক, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় মূল্যবোধের সংরক্ষক’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এটি সেনাবাহিনীর প্রযুক্তিগত উন্নতি এবং একীভূত শক্তি হিসেবে রূপান্তরকেও তুলে ধরেছে।
নতুন চিত্রটির ব্যাকগ্রাউন্ডে তুষারঢাকা পাহাড়, ডান দিকে লাদাখের প্যাংগং লেক এবং বাঁদিকে গরুড় (হিন্দু পুরাণে উল্লেখিত পক্ষীশ্রেষ্ঠ ও বিষ্ণুর বাহন) ও কৃষ্ণের রথ এবং চাণক্যের (রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি বিষয়ে প্রাচীন ভারতের এক দিকপাল) উপস্থিতি রয়েছে। পাশাপাশি, আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম যেমন ট্যাংক, অল-টেরেইন যান, পেট্রল বোট, দেশীয় লাইট কমব্যাট হেলিকপ্টার এবং অ্যাপাচি অ্যাটাক হেলিকপ্টারের চিত্রও প্রদর্শিত হয়েছে।
সেনাবাহিনীর এক সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য হিন্দুকে বলেছেন, ‘এই চিত্রকর্ম এমন একটি দেশকে উপস্থাপন করে, যার সমৃদ্ধ সভ্যতা রয়েছে, যা বরাবরই ন্যায়পরায়ণ এবং প্রয়োজনমতো বলপ্রয়োগে বিশ্বাস করে। এটি সাহসী, আধুনিক ও দক্ষ একটি সেনাবাহিনীকে তুলে ধরে, যারা সব সময় নিজেদের সীমান্ত ও স্বার্থ রক্ষায় প্রস্তুত।’
সূত্রটি আরও জানিয়েছে, এটি মহাভারতের শিক্ষার ভিত্তিতে সেনাবাহিনীর ন্যায়পরায়ণতার প্রতি চিরস্থায়ী অঙ্গীকারকে প্রতিফলিত করে। চাণক্যের কৌশলগত ও দার্শনিক প্রজ্ঞাও এতে অন্তর্ভুক্ত, যা নেতৃত্ব, কূটনীতি এবং যুদ্ধে সেনাবাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে সহায়ক। সাম্প্রতিক সময়ে প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থ অধ্যয়ন এবং ভারতীয় দর্শন ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে একটি ‘দেশজ কৌশলগত শব্দভান্ডার গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
সূত্র আরও জানিয়েছে, এই নতুন চিত্রকর্মটি আধুনিক ভারতীয় সেনাবাহিনীর উন্নত প্রযুক্তি, স্থল, বায়ু ও সাগরের মধ্যে সমন্বয় এবং প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কার্যকর হামলার প্রস্তুতিকে তুলে ধরে। এর মূল বার্তা হলো—সেনাবাহিনীর আত্মত্যাগ, শৃঙ্খলা এবং বীরত্বের ঐতিহ্যকে সম্মান জানানো, পাশাপাশি ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাদের অটুট সংকল্প প্রদর্শন করা।
আপনার মতামত লিখুন