সিলেটের সাদা পাথরের অপরূপ শোভা « বিডিনিউজ৯৯৯ডটকম

সিলেটের সাদা পাথরের অপরূপ শোভা

ডেস্ক নিউজ
আপডেটঃ ৪ জানুয়ারি, ২০২২ | ৭:৩৫
ডেস্ক নিউজ
আপডেটঃ ৪ জানুয়ারি, ২০২২ | ৭:৩৫
Link Copied!

প্রকৃতির সাথে মিলে মিশে থাকার একটা ভাবনাকে জাগ্রত করার চিন্তা খুব কম বয়স থেকে অনুভব করি। মেয়ে উপমা এবং ছেলে শুভমের পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর তাদেরকে সবুজ প্রকৃতির সাথে পরিচয় করে দেওয়ার জন্য সিলেট বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ভোলাগঞ্জ, নাম সংকীর্তন আন্দোলনের প্রচারক মহাপ্রভুর পৈতৃক নিবাস এবং শ্রী মঙ্গল চা বাগান ভ্রমণকে উপযুক্ত মনে করলাম। অগ্রিম টিকেট কাটার জন্য ১২ ডিসেম্বর বৌদি পাপিয়া চক্রবর্ত্তীকে নিয়ে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে সকাল ৮ টায় লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। ১ ঘন্টা দাঁড়ানোর পর টিকেট কাউন্টার থেকে ঘোষণা এল ১৬ তারিখের সিলেট যাত্রীদের টিকেট শেষ হয়ে গেছে। রেলের টিকেট না পেয়ে সৌদিয়া বাস করেই মৌলভী বাজার এলাম। আমাদেরকে রিসিভ করার জন্য এই শীতের ভোরে বাস স্টপে চলে এলেন মৌলভী বাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ব্যবসায় বিভাগের জনপ্রিয় সাবেক শিক্ষক অনুপ চক্রবর্ত্তী।

১৭ তারিখ সকাল বেলা শিল্পী চক্রবর্ত্তী বৌদির হাতে তৈরি গরম গরম চা খেয়ে মহাপ্রভুর আদি বাড়ির উদ্দ্যেশ্য রওনা দিলাম। যাওয়ার সময় মনু নদ অতিক্রম ফেঞ্চুগঞ্জ ইন্দ্রনগরের হাকালুকি হাওরের সবুজ মাঠের অসাধারণ ছবিগুলো এখনো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বিলের মাঝখানে চিল পাখির উড়ে বেড়ানো দেখতে দেখতে কুশিয়ারা নদী পার হয়ে গেলাম। হাওরের পানিতে লাল শাপলার ভেসে থাকার দৃশ্য আর বক পাখির মাছ ধরার দৃশ্য দুইটি মিলে মনে হচ্ছে প্রিয় বাংলার অপরুপ রূপ সামনে এসে জীবন্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছোট ছোট পাহাড়ের ভেতর দিয়ে সবুজ প্রকৃতির অনাবিল আনন্দ নিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম পূন্য ভূমি মহাপ্রভুর বাড়িতে। মহাপ্রভুর বাড়ি যারা দেখাশুনা করে তাদেরকে চট্টগ্রাম থেকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলেন সাতকানিয়া উপজেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক উত্তম চক্রবর্ত্তী। আমরা যাওয়ার সাথে সাথেই গেইটে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারী বুঝতে পারলেন আমরা চট্টগ্রাম থেকেই এসেছি। এই পবিত্র বাড়িটিতে আমাদের বিশ্রাম ও আহারে ব্যবস্থা করে দিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং এই আশ্রমের প্রধান ডক্টর প্রকৃতি চক্রবর্ত্তী। জনশ্রুতি আছে, শ্রী চৈতন্য দেবের দাদা শ্রী উপেন্দ্র মিশ্রের বাড়ি ছিল ঢাকা দক্ষিণের মিশ্রপাড়ায় যেখানে তার পিতা শ্রী জগন্নাথ মিশ্র এবং মাতা শচীদেবী বিবাহ পরবর্তী সময়ে বসবাস করতেন। বিবাহের কিছু দিন পর শচীদেবীর গর্ভবতী হলে তার দিদিমা স্বপ্নে দেখেন যে এই সন্তান হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান; তবে শচীদেবীর সন্তান যেন অন্যত্র ভূমিষ্ঠ হয়। তাই তিনি শ্রী জগন্নাথ মিশ্র এবং শচীদেবীকে নবদ্বীপে পাঠিয়ে দেন ও বলেন যেন তার নাতি তার সাথে দেখা করতে আসেন। ফলে শ্রী চৈতন্য দিদিমার কথা রক্ষার্থে ঢাকা দক্ষিণে এসেছিলেন। উইকিপিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারি অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে তৎকালীন সিলেটের গোলাব রায়ের উদ্যোগে এখানে একটি মন্দির নির্মীত হয়। এটি হিন্দু ধর্মালম্বীদের নিকট একটি ঐতিহাসিক তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত। প্রতিবছর এখানে তীর্থস্থান পরিদর্শনে অসংখ্য পর্যটক আসেন।

পরের দিন মানে ১৮ তারিখ ভোলাগঞ্জ দেখার জন্য ৬০০০ টাকা দিয়ে একটা মাইক্রো ভাড়া নিলাম। মৌলভী বাজার থেকে সকাল বেলা চট্টগ্রামের উদীয়মান তবলাশিল্পী অমর্ত্য চক্রবর্ত্তী, অনুপ চক্রবর্ত্তী দাদার দুই ছেলে অবিরুদ্ধ চক্রবর্ত্তী, অনিরুদ্ধ চক্রবর্ত্তী, সহ আরও ৮ জনকে সাথে নিয়ে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য বের হলাম। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। চারদিকের সবুজ মাঠ দেখতে দেখতে চলতে লাগলাম। সবুজের সাথে মিতালি করতে করতে চা বাগানের পাশ দিয়ে আমরা চলছি। প্রায় দুই ঘন্টা পর আমরা কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ সাদা পাথরের দেশে পৌঁছি।সিলেট থেকে সাদা পাথর পর্যন্ত পুরোটা পথই প্রকৃতি তার সৌন্দর্যে বিমোহিত করবে যে কাউকে। সিলেট নগরীর সীমানা ছাড়ালেই লাক্কাতুরা চা বাগান। সারি সারি চায়ের গাছ দেখতে দেখতেই যাবেন অনেকটা পথ। বাংলাদেশের প্রথম চা বাগান এটি। চা বাগানের সীমানা পেরিয়ে আরো খানিকটা গেলে সালুটিকর বাজার, কোম্পানীগঞ্জের সীমানা শুরু। সিলেটে পাথরের স্বর্গরাজ্য হিসেবে খ্যাত ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারির জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন নতুন পর্যটন স্পট হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে ‘সাদা পাথর’ নামক স্থানটি।

বিজ্ঞাপন

চারদিকে উঁচু পাহাড়ে ঘেরা সবুজের মনভুলানো দৃশ্য চোখের দৃষ্টিশক্তিকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। উপর থেকে নেমে আসা ঝরনার অশান্ত শীতল পানির সর্পিল গতিতে বয়ে চলা, ধলাই নদীর বুকের উপর চিল পাখির মাছ ধরার অপরুপ দৃশ্য পরিবেশকে মোহনীয় করে তুলেছে, চারদিকের পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে প্রকৃতি যেন নিজ হাতে সাজিয়েছে। স্বচ্ছ নীল জল আর পাহাড়ের সবুজ মিলেমিশে একাকার। নদীর বুকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পাথরের বিছানা নদীটির শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে হাজারগুণ। সাদা পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা ঝরনার পানির তীব্র স্রোতে নয়ন জুড়ায় আর শীতল জলের স্পর্শে প্রাণ জুড়িয়ে যায় নিমিষেই। শহুরে যান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি পেতে সারা দেশ থেকেই ছুটে আসেন পর্যটকরা। পথে যেতে দূর থেকেই পাহাড়ের সৌন্দর্য মন কাড়বে আপনার। মন চাইবে দুই হাতে জড়িয়ে প্রকৃতির এই সৌন্দর্যকে আলিঙ্গন করতে। জানা গেছে ভারতের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে নেমে আসা ধলাই নদীর জলের সঙ্গে প্রতিবছর বর্ষাকালে নেমে আসে প্রচুর পাথর। বর্ষাকালে এই জায়গার সৌন্দর্য্য আরও অনেকগুণ বেড়ে যায়। বিশিষ্ট আলোকচিত্র শিল্পী নিশু দাশের ক্যামেরায় আমরা প্রত্যেকে আবদ্ধ হয়ে গেলাম।

নদীর জল দেখলাম, সাদা পাথরে বসে পাহাড়ের সবুজ গাছের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে চিন্তা করলাম সিলেটের চা বাগান না দেখলে ভ্রমণ অতৃপ্ত থেকে যাবে। ১৯ তারিখ সকালে সহধর্মিনী প্রিয়াংকা ভট্টাচার্য্য সহ অন্যদেরকে নিয়ে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। চা বাগানের ভিতর দিয়ে যখন গাড়ি ছুটছে তখন যেদিকে চোখ যাচ্ছে সেদিকেই সবুজের সমারোহ উপভোগ করছি। আমার সাথে ছোট যারা গেছে তারা চা বাগানের অনেক ভিতরে চলে গেছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন সিলেটের শ্রীমঙ্গল চা বাগান কে বাংলাদেশের চায়ের রাজধানী বলা হয়। সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত এ চা বাগান। মৌলভীবাজার এলাকায় 92 টি চা বাগান রয়েছে। 450 বর্গ কিলোমিটার জুড়ে শ্রীমঙ্গলের চা বাগান বিস্তৃত। আর চা-বাগানের মনোরম দৃশ্য পর্যটকদেরকে আকৃষ্ট করে তুলে। নজরকাড়া সব মনমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে লোকজন ছুটে আসে চারদিক থেকে। মাইলের পর মাইল জুড়ে চা বাগান দেখে মনে হয় পাহাড়ের ঢালে সবুজ গালিচা।
শ্রীমঙ্গলে প্রবেশ করার সময় দেখা যাবে চা কন্যা ভাস্কর্য। যা আপনার মনটা প্রথমেই কেড়ে নেবে সে জায়গা। জেলা প্রশাসন ধারা এই ভাস্কর্যটি তৈরি করা হয়েছে। আর চা বাগান রয়েছে ইংরেজদের কিছু স্মৃতি। যাত্রাপথে ইংরেজ আমলের কিছু নিদর্শন দেখা যায়। শ্রীমঙ্গলে রয়েছে চা গবেষণা কেন্দ্র, বাইক্কা বিল, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, হামহাম জলপ্রপাত, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, নীলকণ্ঠের সাত রংয়ের চা, নয়নাভিরাম মাধবপুর লেক, ৭১’এর বধ্যভূমি, শিতেস বাবুর চিরিয়াখানা, চা জাদুঘর প্রভৃতি। চা গবেষণা কেন্দ্রে গিয়ে চারদিকের পরিবেশ দেখে আমাদের সবার মনে এক অনাবিল আনন্দের উষ্ণ পরশে সিক্ত হয়ে গেল। কর্তৃপক্ষ এই এলাকাটি সুন্দর ভাবেই সাজিয়েছেন।

অনেকগুলো ছবিতে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে সবাইকে নিয়ে মনিপুরীদের নিপুণ হাতে তৈরী কাপড় কেনার জন্য গেলাম। গায়ের চাদর, বিভিন্ন রকম হাতে তৈরী কাপড় দেখতে খুব ভালোই লাগছে। দোকানগুলো থেকে কিছু কেনাকাটা করে শ্রীমঙ্গলের সুপরিচিত নীলকন্ঠ চায়ের দোকানে গেলাম। যে চায়ের দোকানে বিভিন্ন রকমের চা পাওয়া যায়। আমি ছেলের জন্য একটা আট রং এর চা এবং অন্যান্যদের জন্য তাদের পছন্দমত চায়ের অর্ডার করলাম। প্রায় ৪০ মিনিট অপেক্ষা করার পর চা এল। একই গ্লাসে সাত স্তরে সাত রঙের চায়ের কথা অনেকেই জানেন। শৈল্পিক ও আকর্ষণীয় এ চায়ের নামডাক অনেক আগেই বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে গেছে। শ্রীমঙ্গলে যারা বেড়াতে আসেন তারা সাতরঙা চায়ের স্বাদ নিতে ভুলেন না। রমেশ রাম গৌড় অনেক বছর ধরে সাত রঙের এ চা বানিয়ে যাচ্ছেন। তার দুইটি দোকান রয়েছে- শ্রীমঙ্গলের মণিপুরী অধ্যুষিত রামনগর ও কালিঘাট রোডের ১৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের ক্যান্টিনে। এই দোকান দুটির নাম নীলকণ্ঠ টি-কেবিন। যে কেউ চাইলে খুব সহজ উপায়ে ঘুরে আসতে পারেন। শ্রীমঙ্গলে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে আবার আমরা সবাই মৌলভীবাজার শহরে চলে এলাম।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের শান্ত একটি শহর হচ্ছে মৌলভীবাজার। যেখানের বেশিরভাগ মানুষ প্রবাসী। স্থানীয়দের বেশিরভাগ থাকেন কানাডা, লন্ডন, আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মান। প্রবাসীদের বাড়িগুলো দেখছি আর ভাবছি আমাদের চট্টগ্রাম শহরে থাকার জন্য মানুষ বিল্ডিং পাচ্ছেননা আর অন্য দিকে মৌলভী বাজার শহরে অনেক বিল্ডিং খালি পড়ে আছে অথচ থাকার জন্য কোনো মানুষ নাই। সিলেট আর মৌলভী বাজারকে তাই তো লন্ডনের শহর বলা হয়।
সময় দ্রুত শেষ হয়ে যায়। কর্মজীবনে প্রবেশ অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে শ্রীমঙ্গল থেকে বিদায় নিলাম। অনুপ দাদা এবং তার পরিবারের আতিথিয়েতা, সবুজ সমাহারের চোখ জুড়ানো দৃশ্য, ধলাই নদীর স্বচ্ছ পানির কলকল শব্দ, শ্রীমন মহাপ্রভুর আদি বাড়ির ডক্টর প্রকৃতি চক্রবর্ত্তীর অমায়িক ব্যবহার, মৌলভী বাজারে বসাবসরত স্থায়ী মানুষের আঞ্চলিক ভাষা আমার মনে অনেকদিন মনে থাকবে। সময়ের অভাবে বাংলাগানের মরমী শিল্পী হাসন রাজার বাড়িতে এবং সুপরিচিত লোক সংগীতের পুরোধা রাধারমণ দত্তের বাড়িতে যাওয়া হয়নি। আগামীতে যাব এই দুই মহান ব্যক্তির বাড়িতে নতুন কিছু লেখার বাসনায়।

বিষয়ঃ

সর্বশেষ: