পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ রকম অনিয়ম: দুর্নীতি বন্ধে ৫৫ নির্দেশনা ইউজিসির!
বাজেটে প্রাপ্ত ১৩শ কোটি টাকা ব্যয় করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, তবুও ২৯শ কোটি টাকা বাড়তি বরাদ্দ!
একটি দেশের মেরুদণ্ড হিসেবে সর্বপ্রথম বিবেচনা করা হয় শিক্ষাঙ্গনকে। তারপরই অবস্থান আর্থিক খাত বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ। তবে আর্থিক খাতসহ সকল খাতেই সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখে শিক্ষাঙ্গন, এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়। তবে বাংলাদেশের শিক্ষাখাত বরাবরই নানামুখী সমালোচনার জন্য বেশ আলোচিত থাকে। এছাড়া এদেশে শিক্ষাখাতে অনিয়ম, অভিযোগ, দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি জালিয়াতি,বাজেট, কাজে জালিয়াতি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব অনিয়ম-অভিযোগের সাথে কখনো বা রাজনৈতিক দলের শিক্ষার্থী আবার কখনো বা স্বয়ং প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলরাই সরাসরি জড়িত থাকে। এবারও তার কোনে ব্যতিক্রম হয়নি।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বিলাসবহুল বাংলো আছে। তা সত্ত্বেও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বাড়ি ভাড়া ভাতা নিচ্ছেন। বিষয়টিকে বিধিবহির্ভূত হিসাবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। রোববার সংস্থাটি দেশের উচ্চশিক্ষার জন্য ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের ১২ হাজার ২৬৩ কোটি টাকার বাজেট অনুমোদন করেছে। এতে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ লুটপাটের মোট ২০ খাতের তথ্যও উপস্থাপন করা হয়।
ইউজিসির সদস্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমগীর গণমাধ্যমকে জানান, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যেসব খাতে আর্থিক অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে, তা বহুদিন ধরে চলছে। স্বায়ত্তশাসন থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের প্রয়োজনে নিয়ম তৈরি করতে পারে। এরই অপব্যবহার করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা মনে করেন না যে আইনে কেবল একাডেমিক স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, আর্থিক নয়। এক্ষেত্রে তাদেরকে দেশের আইনকানুনের মধ্যে থেকেই আর্থিক প্রশাসন পরিচালনা করতে হবে। আর অপর সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের বলেন, হিসাব ও নিরীক্ষা বিভাগের দীর্ঘ অনুসন্ধান ও তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন রকম দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সেসব যাতে আর না হয়, তা সামনে রেখে পরিপত্র তৈরি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দু-তিনদিনের মধ্যে কমিশনের বৈঠকে পাশ হওয়া সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পেয়ে যাবে।
ইউজিসি চিহ্নিত বিধিবহির্ভূত আর্থিক সুবিধা নেওয়া ২০ খাত হচ্ছে-উচ্চতর স্কেলে বেতন প্রদান; বিধিবহির্ভূতভাবে পঞ্চম গ্রেডভুক্ত কর্মকর্তাকে তৃতীয় গ্রেড প্রদান; ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি ও স্কেল প্রদান, এমনকি যোগদানের তারিখ থেকে পদোন্নতি; অননুমোদিত পদে নিয়োগ, আপগ্রেডেশন ও বেতন প্রদান; অনর্জিত ইনক্রিমেন্ট প্রদান; বেতনের বাইরে নানা নামে উপাচার্য হিসাবে অতিরিক্ত অর্থগ্রহণ; বাংলোতে বসবাস সত্ত্বেও বাড়ি ভাড়া গ্রহণ; পূর্ণ বাড়ি দেওয়ার পরও কম নেওয়ার উদ্দেশ্যে বর্গফুটের হিসাবে ভাড়া গ্রহণ; মফস্বলের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-জনবলকে সিটি করপোরেশনের হিসাবে বাড়ি ভাড়া প্রদান; এর বাইরেও সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ হারে বাড়ি ভাড়া প্রদান; সরকারি নিয়ম লঙ্ঘন করে সেশন বেনিফিট প্রদান; পিআরএলের পরিবর্তে এলপিআর প্রদান; বিদ্যুৎ-গ্যাস বিল ভর্তুকি দেওয়া; গবেষণা-মোবাইল-টেলিফোন-ইন্টারনেট ভাতা প্রদান, নিয়মের বাইরে বইভাতা দেওয়া; ড্রাইভারদের নবম থেকে পঞ্চম গ্রেডে বেতন দেওয়া; চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে সরকারের আর্থিক নীতিমালা লঙ্ঘন এবং যৌথ বিমা বা কল্যাণ তহবিলে (অর্থ) স্থানান্তর।
ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের বলেন, গত বছর ৪১টি নির্দেশনা পাঠানো হলেও এবার পরিস্থিতি অনুযায়ী আরও ১৪টি যোগ করা হয়েছে। চিহ্নিত ২০টি অনিয়মের তথ্য প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হবে। পাশাপাশি কোন বিশ্ববিদ্যালয় কী রকম অনিয়মে জড়িত, তাও উল্লেখ থাকবে। অনিয়ম সম্পর্কে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়কে ২০ জুনের মধ্যে ইউজিসিকে জানাতে হবে।
ব্যয় হয়নি তবু বেড়েছে বরাদ্দ : সূত্র জানায়, সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতি জুনে নিজস্ব বাজেট ঘোষণা করে। এর আগে ইউজিসি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকূলে বরাদ্দ ঘোষণা করে। রোববারের বৈঠকে ইউজিসির স্থায়ী ও খণ্ডকালীন সদস্যরা যোগ দেন। তারা ৫৫ দফা নির্দেশনা অনুমোদন করেন। পাশাপাশি কৃচ্ছ সাধনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দেওয়া ৯ নির্দেশনাও অনুমোদন করে।
বৈঠকে দেশের ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউজিসি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। এ খাতে আসন্ন অর্থবছরে ১২ হাজার ২৬২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ব্যয় হবে। এর মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য রাজস্ব খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৬ হাজার ১০৯ কোটি ১০ লাখ টাকা, আর উন্নয়ন বাজেট বা ৩১টি প্রকল্পের অনুকূলে ৬ হাজার ৭৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকছে। অপরদিকে ইউজিসির জন্য ৭৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত বছর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ছিল ১০ হাজার ৫১৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা আর ইউজিসির জন্য ৭১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেবল ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশোধিত বাজেটে ৯ হাজার ২৬৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। অর্থাৎ, প্রায় ১৩শ কোটি টাকা ব্যয় করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এরপরও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরাদ্দ বেড়েছে ২ হাজার ৯২০ কোটি টাকা।
৫৫ নির্দেশনা : নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউজিসির এক সদস্য গণমাধ্যমকে বলেন, চিহ্নিত ২০ খাতের অর্থ লুটপাট বন্ধে এ ৫৫ নির্দেশনা ভূমিকা রাখতে পারে। এগুলোর একটি হচ্ছে-১০ জুনের মধ্যে ৫০ বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের চলতি অর্থবছরের সংশোধিত ও নতুন বছরের প্রাথমিক বাজেট পাঠাতে হবে। প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষার আয়ের সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ ব্যয় করা যাবে। বাকি ৪০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা করতে হবে। আর এ আয় নিজস্ব আয়ের মধ্যে অবশ্যই দেখাতে হবে। এছাড়া ভর্তি, টিউশন, পরীক্ষা, ল্যাব টেস্ট, বিশেষ কোর্স, বেতন থেকে কর্তনাদি, সম্পত্তি থেকে লব্ধ অর্থ প্রভৃতি অবশ্য নিজস্ব আয় হিসাবে বাজেটে দেখাতে হবে। বিভিন্ন প্রকার ব্যয়ে প্রযোজ্য হারে ভ্যাট ও কর আদায় করতে হবে। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়িত্বভাতা বেতনের ১০ শতাংশ বা দেড় হাজার টাকার মধ্যে যেটি কম, সেটি দেওয়া যাবে। অগ্রিম দেওয়া অর্থ সংশ্লিষ্ট অর্থবছরের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। আরও আছে-এক খাতের অর্থ অন্য খাতে কিংবা মূল খাতের অর্থ অভ্যন্তরীণ কোনো খাতেই সমন্বয় করা যাবে না। কমিশনের অনুমতি ছাড়া কোনো খাতে বরাদ্দের অতিরিক্ত ব্যয় করা যাবে না। কোনো খাতে বাড়তি অর্থের দরকার হলে ইউজিসিকে অবহিত করতে হবে। এসব অনিয়ম, দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলেই দেশের শিক্ষা খাত পুরোপুরি বিপদমুক্ত হবে। কারণ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তুলনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি সবার ফোকাস বেশি থাকে। তাই তাদেরকে দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে।