ফুটবল তারকা : যাদের শৈশব কেটেছে দারিদ্র্যে « বিডিনিউজ৯৯৯ডটকম

ফুটবল তারকা : যাদের শৈশব কেটেছে দারিদ্র্যে

ডেস্ক নিউজ
আপডেটঃ ২ ডিসেম্বর, ২০২২ | ১১:২৫
ডেস্ক নিউজ
আপডেটঃ ২ ডিসেম্বর, ২০২২ | ১১:২৫
Link Copied!

মাঠে এবং মাঠের বাইরে ফুটবলের যে তারকাদের জীবন আমাদের কাছে এত মোহনীয় ও আকর্ষণীয় মনে হয়, আজকের এই অবস্থানে পৌঁছাতে তাদের বছরের পর বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে। তাদের সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি?

শৈশব থেকে দারিদ্র্যের শত বাঁধা ও প্রতিবন্ধকতার পথ পেরিয়ে আজ তাদের এই ঝকমকে সাফল্যের জীবন। জেনে নিই গ্রাম বা শহরতলি থেকে উঠে আসা কয়েকজন বিশ্বখ্যাত ফুটবল তারকার পেছনের জীবন।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের তারকা অ্যালেক্সিস স্যাঞ্চেজ। প্রতি সপ্তাহে ৩৫০ হাজার পাউন্ড বেতনের এই খেলোয়াড়কে হাত খরচের পয়সার জন্য মাত্র ছয় বছর বয়সে গাড়ি ধুতে হয়েছে। সার্কাসে খেলা দেখাতে হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

চিলির এটোপিয়া খনি অঞ্চলের এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেন তিনি। তার বাবা ছিলেন একজন খনি শ্রমিক। শৈশবেই তার বাবা তাদের ছেড়ে চলে যান। মা এবং বিপিতার সাথে একটা ছোট্ট ঘরে থাকতেন তিনি। তবে জন্মগত প্রতিভা ও কঠোর পরিশ্রমে আজ তিনি চিলির সবচেয়ে ধনাঢ্য খেলোয়াড়দের একজন।

বস্তির অন্ধকার জীবন ও অরাজকতার জন্য পরিচিত ফ্রান্সের পোসিকিয়ুমো শহর। সেই শহরে জন্ম নেয় প্রেভ মেরি। এই খেলোয়াড়ের শৈশব কেটেছে শহরের দরিদ্রতম এলাকায়। দুই বছর বয়সে এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে তার পরিবার দুর্ভাগ্যের মুখোমুখি হয়।

নিজে সেই সড়ক দুর্ঘটনায় বেঁচে গেলেও প্রেভ মেরির মুখে ১০০টি সেলাই পড়েছিল যার ফলে তার মুখে আজও দুটো বড় দাগ রয়ে গেছে। এজন্যই এই মিড-ফিল্ডারের ডাক নাম ‘স্কার’ (ক্ষত)।

বিজ্ঞাপন

২০০৩ সালে পেশাদার ফুটবল খেলা শুরু করার আগে প্রেভ মেরি এবং তার বাবা পরিবারের দৈনিক আহার জোগানোর জন্য রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। তবে মেস্ট ক্লাবের নজরে পড়ার পর প্রেভ মেরি ও তার পরিবারের জীবন বদলে যায়। পরবর্তী সময়ে প্রেভ মেরি তুরস্কে গালাতাসারে ক্লাবে খেলতে যান।

অভিবাসী পাড়ার দরিদ্র রাস্তায় পথ চলতে চলতে শৈশবে বহু দিন তাকে চুরিও করতে হয়েছে এবং চুরি ছাড়া খাবার জোটানোর অন্য কোনো রাস্তা ছিল না বলে জ্লাতান ইব্রাহোমোভিচ মিডিয়ার কাছে স্বীকার করেন…
সেখান থেকে ফ্রান্সে প্রথমে মার্ক্সে ক্লাবে খেলতে দেশে ফেরেন এবং পরে বেওমোনিক ক্লাব (Beomonic club)-এ যোগ দেন। ফুটবল না খেললে প্রেভ মেরিকে হয়তো বস্তিতে তার অন্যান্য বন্ধুর মতোই বেকারদের খাতায় নাম লেখাতে হতো। এত বড় তারকা হওয়ার পরেও তিনি কিছুতেই তার অতীত ভুলতে পারেন না।

তিন ভাইবোনের পরিবারের ডি মারিয়া পশ্চিম আর্জেন্টিনার দরিদ্র শহরে বড় হয়েছেন। শৈশবে ডি মারিয়া ও তার দুই বোনকে কয়লাখনির মজুর বাবা-মা’কে কাজে সাহায্য করতে হতো।

ডি মারিয়ার অন্তর্নিহিত প্রতিভার স্ফুরণ শৈশবেই ঘটেছিল। তবে সেই বাচ্চা বয়সে খেলার জন্য এক জোড়া ভালো জুতাও তার ছিল না। শৈশবের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘ছেলেবেলায় অনেকদিনই ক্ষুধা নিয়ে আবর্জনায় ছেঁড়া জুতা খুঁজতাম’—সত্যিই ভারি কষ্টকর জীবন। আজ কিন্তু ডি মারিয়া অঢেল অর্থ আয়ের সময়ও তার পরিবারের কথা স্মরণে রাখেন।

রোজারিও সেঞ্চা ক্লাব থেকে বেনফিকা ক্লাবে বদলি হওয়ার সময় ডি মারিয়া ঘোষণা করেন যে তিনি ক্রয় কর্মীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখন থেকে পুরোদস্তুর ফুটবলার হবেন এবং তার বাবা-মা’কে এসময় তিনি পূর্ণাঙ্গ আসবাবপত্র সজ্জিত একটি বাড়ি কিনে দেন। এই ডি মারিয়াকেই মাত্র ছয় বছর বয়সে উরুগুয়ের রিয়ো নদীর পাড়ের দরিদ্র নগরী স্যান্টোর রুক্ষ ও অসমতল রাস্তায় খেলতে হয়েছে।
তার যখন সাত বছর বয়স, তখন তার পরিবার উরুগুয়ের রাজধানী মন্টের ভেরিও শহরে পাড়ি জামায়। সেখানে তার বাবা কুলির কাজ নেন এবং এভাবেই নয়টি মাস পরিবারের মুখে খাবার জুগিয়েছেন। দূষণ এবং সামাজিক নানা অশান্তিতে পরিপূর্ণ মন্টের ভেরিওতে ডি মারিয়া বড় হন।

তবে শৈশবে ‘রাস্তার শিশু’র জীবনকে তিনি গুরুত্ব দেন। নানা অভিজ্ঞতা, জীবনে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় খানিকটা চতুরতা এবং খানিকটা ক্ষ্যাপাটেপনা রাস্তার জীবন দিতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

রোনালদোর মা ছেলের স্কুল ছাড়ার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেও রোনালদো তার নিজের সিদ্ধান্তে ছিলেন অনড়। পরের গল্পটুকু সাফল্যের…
নয় বছর বয়সে ডি মারিয়া আর্সেনাল ক্লাবের নজরে পড়েন। কৈশোর না পেরোতেই সোফিয়া প্যানবিস নামের মেয়ের সাথে পরিচয় তাকে জীবনে ইতিবাচক হতে ভরসা জোগায়। প্রথম দেখাতেই সোফিয়ার প্রেমে পড়েছিলেন তিনি। নেদারল্যান্ডে আসার পরই তার দ্রুত কাজে উন্নতি হয় এবং গেবার্ন ক্লাবে অল্প কিছুদিন খেলতে না খেলতেই বার্সায় জায়গা পান। এখন তিনি মহাতারকা।

ক্রোয়েশিয় মা এবং মদ্যপ, ব্রোস্টিয় বাবার দরিদ্র, ঝড়ো দাম্পত্য থেকে যেমন এসি মিলান ক্লাবের অতীত তারকা খেলোয়াড় মার্কো ভন বাস্তেনের জন্ম, আর দশটি অভিবাসী পরিবারের শিশুর মতোই জ্লাতান ইব্রাহোমোভিচও মাত্র দুই বছর বয়সে বাবা-মা’র বিচ্ছেদের পর জীবনে কঠিন সংকটের মুখোমুখি হন।

অভিবাসী পাড়ার দরিদ্র রাস্তায় পথ চলতে চলতে শৈশবে বহু দিন তাকে চুরিও করতে হয়েছে এবং চুরি ছাড়া খাবার জোটানোর অন্য কোনো রাস্তা ছিল না বলে জ্লাতান ইব্রাহোমোভিচ মিডিয়ার কাছে স্বীকার করেন। কিন্তু এই কঠিন জীবনই তার ভেতর দৃঢ় ইচ্ছেশক্তি, প্রতিরোধ এবং নানা গুণের জন্ম দেয় যা একইসাথে ফুটবল খেলা খেলতে শেখা তার অন্য রাস্তার বন্ধুদের চেয়ে তাকে এত দূর এগিয়ে এনেছে।

মাত্র ১৫ বছর বয়সে, ম্যাম্বো ক্লাবের একজন উদীয়মান ও প্রতিভাবান খেলোয়াড় হওয়া সত্ত্বেও মা’কে টাকা দিয়ে সাহায্য করার জন্য কিছুদিনের মতো তিনি ফুটবল খেলা ছেড়ে কুলির কাজ নিয়েছিলেন। তবে, উদ্বিগ্ন এক ফুটবল কোচ তখন তাকে বোঝোতে এলে পরে তিনি আবার খেলায় মনোনিবেশ করেন।

‘ফুটবলের উপর তোমার মনোযোগ একারণে দেওয়া উচিত যাতে করে অভাব থেকে পালানোর একটি পথ তুমি খুঁজে পাও’—জ্লাতানকে এভাবেই উপদেশ দেন তার কোচ। বাকিটা ইতিহাস। মাম্বা ক্লাবে জ্লাতানের খেলায় আমর্স্টাডামের অ্যাঞ্জাক ক্লাব তাকে নিয়ে নেয়। আজ তিনি ইউরোপের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে স্বীকৃত।

বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবল তারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। তার মা অন্তসত্ত্বা অবস্থাতেই পারলে তাকে পরিত্যাগ করতেন। কারণ অনাগত শিশুটির জন্ম মানেই পরিবারে খাবারের মুখ একজন বেড়ে চারজন হওয়া।

তেরো বছর বয়সে স্কুলের যে শিক্ষক রোনালদোর পরিবারের অর্থাভাব নিয়ে তাকে বিদ্রূপ করছিলেন, তার মুখে চেয়ার ছুড়ে মেরে তিনি স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন। এরপরেই রিয়্যাল মাদ্রিদের অনাগত দিনের এই সুপারস্টার স্কুল থেকে ড্রপ-আউট হয়ে ফুটবলকেই আলিঙ্গনের সিদ্ধান্ত নেন। রোনালদোর মা ছেলের স্কুল ছাড়ার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেও রোনালদো তার নিজের সিদ্ধান্তে ছিলেন অনড়। পরের গল্পটুকু সাফল্যের।

মাত্র বারো বছর বয়সে বোটিন লিস্টপন্ট ক্লাব রোনালদোকে খেলোয়াড় হিসেবে গ্রহণ করে। তিনি অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৭ এবং অনূর্ধ্ব-১৮ টিমে খেলেন এবং ২০০৩ সালের গ্রীষ্ম নাগাদ ‘ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ক্লাব’-এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার আগেই নিজ দেশের জাতীয় দলে ২০০১-২০০২ নাগাদ খেলার সুযোগ পান। আর আজ তিনি ফুটবলের এক কিংবদন্তী।

অদিতি ফাল্গুনী ।। উন্নয়নকর্মী, কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক

সর্বশেষ: