বাংলাদেশে ইয়াবা-আইস পাচারে তৎপর মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা « বিডিনিউজ৯৯৯ডটকম

অস্ত্রের টাকা জোগাতেই সকল অপকর্ম

বাংলাদেশে ইয়াবা-আইস পাচারে তৎপর মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা

সিনিয়র রিপোর্টার
আপডেটঃ ১১ মে, ২০২৪ | ২:২৭
সিনিয়র রিপোর্টার
আপডেটঃ ১১ মে, ২০২৪ | ২:২৭
Link Copied!
মিয়ানমারের ভয়াবহ মাদক বাংলাদেশে -- বিডিনিউজ৯৯৯ডটকম

কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তে রয়েছে প্রায় তিন কিলোমিটার প্রস্থের নাফ নদী। ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। এই নদী পেরিয়ে আসছে ইয়াবা, আইস, হেরোইন থেকে শুরু করে ভয়ংকর সব মাদক। বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে মাদকের বাহকেরা গ্রেপ্তার হলেও মূল হোতা ও পৃষ্ঠপোষকেরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে থামছে না মাদকের কারবার। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর চলমান সংঘাতের ফলে সীমান্ত দিয়ে মাদকের প্রবাহ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে পুলিশ সদর দপ্তর।

গত ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশে মাদকের আগ্রাসন রোধকল্পে গঠিত স্ট্রাটেজিক কমিটির তৃতীয় সভা। সেই সভায় পুলিশ সদর দপ্তরের তৈরি করা একটি প্রতিবেদন তুলে ধরেন বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি)। ওই প্রতিবেদনে পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, মিয়ানমারে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর অস্ত্র কেনার জন্য টাকা দরকার। সেই টাকা জোগাড় করতে এপারে বাংলাদেশ সীমান্তে থাকা রোহিঙ্গা ও দেশি কারবারিদের কাছে অল্প দামে মাদক বিক্রি করছে তারা। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা বাড়ার সঙ্গে দেশে মাদকের প্রবাহও বাড়ছে। পাশাপাশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে টেকনাফ এলাকাকেন্দ্রিক মাদকের শীর্ষ কারবারিরা।

মাদক কারবারিদের নিয়ে গত বছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে তালিকা করেছে, তাতে কক্সবাজার জেলার ১ হাজার ১৫১ জনের নাম আছে। এর মধ্যে ৯১২ জনই টেকনাফের। তালিকার শীর্ষ ৭৩ জন ইয়াবা কারবারির ৬৫ জনই টেকনাফের। এই তালিকার হালনাগাদ করা হচ্ছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

বিজ্ঞাপন

মাদকের আগ্রাসন রোধে গঠিত স্ট্রাটেজিক কমিটির সভায় আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা যত বাড়ছে, টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে দেশে মাদকের প্রভাব তত বাড়ছে। মূলত এ সময় রোহিঙ্গাসহ দেশের মাদক কারবারিদের কাছে ইয়াবা আর আইস কম দামে বিক্রি করছে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী। কম দামে মাদক পাওয়ায় টেকনাফের কারবারিরাও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। রোহিঙ্গা কারবারিদের পাশাপাশি দেশীয় শীর্ষ মাদক কারবারিরা নিজেদের কাছে মাদক কিনে গচ্ছিত করে রাখছে। ইয়াবা-আইস বিক্রির সেই টাকা দিয়ে মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা নিজেদের খরচ চালাচ্ছে ও অস্ত্র কিনছে।

টেকনাফের মাদক নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এমন প্রতিবেদনের বিষয়ে কক্সবাজার জেলা পুলিশের সুপার মোহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম বলেন, প্রতিবেদনের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বে থাকা ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক মোহাম্মদ ইকবাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, শুধু মাদক নয়, ক্যাম্পে যেকোনো অপরাধ নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান সব সময় শক্তিশালী। তবে মাদকের পুরো সিন্ডিকেট পুলিশের পক্ষে একা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। অন্য বাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।

মিয়ানমার থেকে কী পরিমাণ মাদক আসছে, তার কিছুটা উঠে এসেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যে। সংস্থাটির হিসাব বলছে, গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে ৪ কোটি ২৯ লাখ ৭৭ হাজার ২১৯টি ইয়াবা জব্দ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তার আগের বছর ২০২২ সালে ৪ কোটি ৫৮ লাখ এবং ২০২১ সালে ৫ কোটি ৩০ লাখ ৭৩ হাজার ৬৬৫টি ইয়াবা উদ্ধার করে। যদিও জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (ইউএনওডিসি) দাবি, বাংলাদেশে যত মাদক ঢুকছে, এর মাত্র ১০ শতাংশ ধরা পড়ে।

বিজ্ঞাপন

সর্বশেষ গত ২৯ এপ্রিল কক্সবাজারের চকরিয়ায় নদীতে অভিযান চালিয়ে সাড়ে ১২ লাখ ইয়াবা জব্দ করেছে চকরিয়া থানার পুলিশ। পুলিশ বলছে, থানার পুলিশ এর আগে ইয়াবার এত বড় চালান জব্দ করতে পারেনি। এটাই সবচেয়ে বড়।

চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, নদীপথে টেকনাফ থেকে ইয়াবার বড় একটি চালান চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিল। পরে চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়নের বহলতলী এলাকায় মহেশখালী চ্যানেলে (নদীতে) অবস্থান নেয় পুলিশের কয়েকটি দল। এ সময় একটি নৌযান থেকে ইয়াবাভর্তি প্লাস্টিকের পাঁচটি ড্রাম জব্দ করা হয়। ড্রামগুলো কেটে একে একে বের করা হয় টেপ মোড়ানো ১২৫টি প্যাকেট। এসব প্যাকেটের প্রতিটিতে ১০ হাজার করে ইয়াবা থাকে।

পুলিশ সূত্র বলছে, চালান জব্দের দুই দিন আগে মিয়ানমারের এক বিদ্রোহী গোষ্ঠী থেকে ইয়াবাগুলো কেনেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করা মাদক কারবারিরা। তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে দেশি কারবারিদের তত্ত্বাবধানে চালানটি চট্টগ্রামে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়। পরে অবশ্য এ ঘটনায় পুলিশ শাহজাহান নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে। যিনি চালানটি চট্টগ্রামে পৌঁছে দিতে সহযোগিতা করেছিলেন।

মাদকের সরবরাহ হ্রাস করতে মাদক কারবারি তালিকা হালনাগাদ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ টেকনাফে যৌথ অভিযান পরিচালনার পরামর্শ দিয়েছে পুলিশ। সঙ্গে জোরদার করতে বলা হয়েছে টাস্কফোর্সের কার্যক্রম।

এ নিয়ে পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যত দিন পর্যন্ত মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বন্ধ না হবে, তত দিন পর্যন্ত সীমান্তে মাদক প্রবেশ ঠেকাতে কড়া নজরদারি বসাতে হবে। তা ছাড়া টেকনাফের শীর্ষ মাদক কারবারিদের গতিবিধি অনুসরণ করতে হবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতর ও টেকনাফের কারবারিদের সন্দেহভাজন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করতে হবে। যেকোনো মূল্যে মিয়ানমার থেকে মাদকের সরবরাহ হ্রাস করার বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।

২০১৮ সালে মাদকের দৌরাত্ম্য কমাতে বিশেষ করে ইয়াবা বন্ধে দেশে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়, তখন ক্রসফায়ারে বেশ কয়েকজন মাদক গডফাদারসহ মাঝারি ধরনের কারবারি নিহতও হয়েছিল। কিন্তু তাতেও কক্সবাজার টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মাদকের প্রবেশ কমেনি। দেশে নিয়মিতই ঢুকছে সর্বনাশা মাদক ইয়াবা।

জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী বলেন, বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন তথ্য দিয়েছে। মাদকের প্রবাহ রোধে বেশ কিছু পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হয়েছে। সব বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ে কাজগুলো করা হবে। যেকোনো মূল্যে মাদকের প্রবেশ ঠেকাতে হবে।

বিষয়:

সর্বশেষ: