শবে বরাতে কি ভাগ্য নির্ধারিত হয় ? আলেমগণ যা বলছেন

শবে বরাত ইসলামি ঐতিহ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। হাদিস ও ইসলামি স্কলারদের মতে, এই রাতটি বিশেষ ফজিলতপূর্ণ। তাই অনেকে এ রাতে নফল ইবাদত, তাহাজ্জুদ, জিকির-আজকার ও কোরআন তিলাওয়াতে ব্যস্ত থাকেন। তবে একটি প্রচলিত ধারণা রয়েছে—শবে বরাতে মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। সত্যিই কি এমনটা হয় ? কি বলছেন আলেমগণ ?
বিষয়টি নিয়ে অনেকে বিশ্বাস করেন, এই রাতে মানুষের হায়াত-মউত, রিজিকসহ ভাগ্য সংক্রান্ত বিষয় নির্ধারণ করা হয়। এর পক্ষে কিছু বর্ণনা পাওয়া গেলেও হাদিস বিশারদদের মতে, এসব হাদিস অত্যন্ত দুর্বল বা বানোয়াট। কোরআন ও সহিহ হাদিসে শবে বরাতকে ভাগ্য নির্ধারণের রাত হিসেবে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়নি।
কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন— আমি তা অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক রজনীতে এবং আমি তো সতর্ককারী। এ রজনীতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়। (সূরা দুখান, আয়াত ৩-৪)
তাবিয়ী ইকরিমাহ (রহ.) ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, এখানে ‘মুবারক রজনী’ বলতে শবে বরাতকে বোঝানো হয়েছে এবং এ রাতে মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। তবে অধিকাংশ মুফাস্সির এই ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
ইমাম তাবারি (রহ.) বলেন, এখানে ‘মুবারক রজনী’ বলতে লাইলাতুল কদরকে বোঝানো হয়েছে। কারণ কোরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ রমজান মাসে কোরআন নাজিল করেছেন। তাই ‘লাইলাতুল মুবারাকা’ বলতে শাবানের কোনো রাত নয়, বরং লাইলাতুল কদরকেই বোঝানো হয়েছে। (তাফসির তাবারি, ২৫/১০৭-১০৯)
পরবর্তী যুগের মুফাস্সিরগণও ইমাম তাবারির ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত হয়েছেন। তারা বলেন, লাইলাতুল কদর ও লাইলাতুম মুবারাকা একই রাতের দুটি উপাধি।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-হাদিস ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর শবে বরাত সম্পর্কে বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন— আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন।
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, শবে বরাতে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে। তবে তিনি ব্যাখ্যায় বলেন, কেউ যদি বিশেষ কোনো আমল না-ও করে, তবুও আল্লাহর পক্ষ থেকে এই বিশেষ রহমতের সুযোগ পেয়ে যাবেন।
তিনি আরও বলেন, শবে বরাতের রাতে ইবাদতের ব্যাপারে কোনো সহিহ হাদিস নেই। তবে কিছু দুর্বল হাদিসে কবর জিয়ারত, দোয়া ও সালাতের কথা উল্লেখ রয়েছে। তাই কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে ইবাদত করেন, দোয়া করেন বা সালাত আদায় করেন, তা করা যাবে, তবে একে বিশেষ দিবস হিসেবে মনে করা ঠিক নয়।
তবে এই রাতে মসজিদে গিয়ে দলবদ্ধ হয়ে ইবাদত করা, বিশেষ কোনো নির্দিষ্ট আমল স্থির করা বা এটিকে ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালন করা বিদআত বলে তিনি মত দেন। একইভাবে, ‘শবে বরাতে মানুষের ভাগ্য লেখা হয়’—এমন যে কোনো বিশ্বাসও বিদআত হিসেবে গণ্য হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সুতরাং, শবে বরাতে ভাগ্য নির্ধারণের ব্যাপারটি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত নয়। তবে এই রাতের ফজিলত রয়েছে এবং এটিকে ইবাদতের মাধ্যমে কাটানো একটি প্রশংসনীয় আমল। তবে ভুল ব্যাখ্যা ও ভিত্তিহীন বিশ্বাস থেকে বিরত থাকা জরুরি বলে আলেমরা মত দেন।
আপনার মতামত লিখুন