অমর একুশে বইমেলায় কুরুচির মহিলা খ্যাত বিতর্কিত তসলিমা নাসরিনের বই রাখাকে কেন্দ্র করে ‘সব্যসাচী’ স্টলে হামলা ও হট্টগোলকে কেন্দ্র করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। মঙ্গলবার বাংলা একাডেমির সচিব ও বইমেলা টাস্কফোর্স কমিটির প্রধান সেলিম রেজা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, সোমবারের ঘটনায় ৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি ৩ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে। তারপর আমরা একটি সিদ্ধান্তে আসব।
এদিকে ‘সব্যসাচী’ প্রকাশনার স্টলে বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বই বিক্রি ও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়াকে কেন্দ্র করে স্টল ভাঙচুরের পর পুলিশ প্রকাশক শতাব্দী ভবকে আটক করে। সোমবার সন্ধ্যায় আটকের পর রাত ১২টার দিকে মুচলেকা নিয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ। হামলার পর থেকে বন্ধ রয়েছে স্টলটি।
মূলত অমর একুশে বইমেলায় সব্যসাচী স্টলে লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বই রাখা নিয়ে কয়েক দিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উত্তেজনা ছড়াচ্ছিল। এরই মধ্যে সোমবার সন্ধ্যায় ‘তৌহিদি জনতা’র নামে একদল লোক স্টলটিতে হামলা চালায়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. মাসুদ আলম গণমাধ্যমে বলেন, তসলিমা নাসরিনের বই রাখায় বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলায় সব্যসাচী প্রকাশনার স্টলে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। সোমবার সন্ধ্যায় তৌহিদি জনতার নামে একদল লোক উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করলে পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দিতে শতাব্দী ভবকে বইমেলায় পুলিশের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে নিয়ে যায়। পরে ঘটনাস্থল থেকে আটজন এবং শতাব্দী ভবকে থানায় নেওয়া হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। পরে পৃথক মুচলেকা নিয়ে সোমবার রাতেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন একদম স্বাভাবিক বলে জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, শতাব্দী ভবর বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে বাংলা একাডেমি। এটা তাদের বিষয়। স্টল বন্ধ থাকার কোনো নির্দেশনা আমরা দেইনি। পরে লেখক, প্রকাশক সমিতিসহ সংশ্লিষ্টরা সিদ্ধান্ত নেবেন বলে তিনি জানান।
এদিকে হামলার পর সব্যসাচীর প্রকাশক শতাব্দী ভবর স্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেন, হুমকির বিষয়টি ২ দিন আগেই পুলিশকে জানিয়েছিলেন। তার এমন দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে ডিসি মাসুদ আলম বলেন, এ বিষয়টি আমরা জানি না। তার স্ত্রীর সঙ্গে আমার কখনো কথা হয়নি। আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। আমরা যখন জেনেছি তখন এটা নিয়ে কাজ করেছি।
জানা যায়, চলতি বইমেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে সব্যসাচী প্রকাশনা সংস্থার স্টলে (১২৮ নম্বর স্টল) রাখা হয়েছিল তসলিমা নাসরিনের বিতর্কিত বই ‘চুম্বন’। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কয়েক দিন ধরেই নানা বিতর্ক চলছিল। সোমবার সন্ধ্যায় একদল লোক স্টলটিতে গিয়ে প্রকাশককে ঘিরে ধরে স্লোগান দেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ প্রকাশক শতাব্দী ভবকে বইমেলায় তাদের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে নিয়ে যায়। পরে পুলিশের নিয়ন্ত্রণ কক্ষও ঘিরে রাখেন উত্তেজিত জনতা। তারা দাবি করেন, শতাব্দী ভব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কটাক্ষ করে ইসলামপন্থিদের ‘জঙ্গি’ বলে গালাগাল করেছেন এবং মেলায় এসে ‘জয় বাংলা/জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে সাধারণ-জনতার ওপর হামলা করেছেন।
জানা যায়, শতাব্দী ভব হামলার শঙ্কার কথা আগেই বলেছিলেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ভিডিও বার্তাও দিয়েছিলেন। তার স্ত্রী সানজানা গণমাধ্যমকে বলেন, তসলিমা নাসরিনের বই রাখার কারণে ২ দিন ধরে কিছু লোক সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে আমাদের স্টল গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে আসছিল। এই বিষয়টি পুলিশ এবং বইমেলা কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তারা বই সরিয়ে নিতে বললে, বই সরানো হয়েছে। তারপরও স্টলে হামলা করেছে।
এমন হুমকির বিষয়ে খোদ লেখিকা তসলিমা নাসরিনও সোমবার বিকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
একুশে বইমেলায় স্টলে হামলার ঘটনায় সোমবার রাতেই এক বিবৃতিতে কঠোর নিন্দা জানিয়েছেন অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, এ হামলা বাংলাদেশের নাগরিকদের অধিকার ও দেশের আইনের প্রতি চরম অবমাননার প্রতিফলন। এমন সহিংসতা এ মহান সাংস্কৃতিক আয়োজনের মুক্তচিন্তার চেতনাকে লঙ্ঘন করে। যা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি মাতৃভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গকারী ভাষা শহিদদের স্মরণে অনুষ্ঠিত হয়। একুশে বইমেলা আমাদের লেখক ও পাঠকদের প্রতিদিনের মিলনমেলা।
এদিকে শোভা প্রকাশনী (প্যাভিলিয়ন-৩) থেকে মেলায় এসেছে আবদুল হাই শিকদারের বই ‘জ্যোতির্ময় জিয়া এবং কালো মেঘের দল’।
একাদশ দিনে নতুন বই ৯১টি:
বাংলা একাডেমির জনসংযোগ উপবিভাগ জানায়, মঙ্গলবার মেলার একাদশ দিনে নতুন বই এসেছে ৯১টি। এ পর্যন্ত মেলায় মোট নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে ৮২৮টি। এর মধ্যে গল্পের বই ১০৫টি, উপন্যাস ১৫৪, প্রবন্ধ ৩৫, কবিতা ২৫৩, গবেষণা ১৬, ছড়া ১১, শিশুতোষ ১৭, জীবনী ২৬, রচনাবলি ৬, মুক্তিযুদ্ধ ৭, নাটকের বই ১০টি।
এছাড়া বিজ্ঞান ১৮, ভ্রমণ ১০, ইতিহাস ২৪, রাজনীতি ১২, চিকিৎসাশাস্ত্র ২, ভাষার বই ৫, গণঅভ্যুত্থান ৫, ধর্মীয় ১৫, অনুবাদ ৬, অভিধান ২, সায়েন্স ফিকশন ৬ ও অন্যান্য ৮০টি।
আপনার মতামত লিখুন