সারাদেশে চলছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বাজার অগ্নিশর্মা। সরকারের তদারকি সংস্থাগুলোর অভিযান ঠেকাতে সিন্ডিকেট করে পাইকারি পর্যায়ে ঢাকার তেজগাঁও ও চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে আড়তের ব্যবসায়ীরা ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছে।
গত রোববার রাত থেকে আড়তে আনা হয়নি কোনো ডিম। ফলে সোমবার সকাল থেকে বিক্রিও বন্ধ ছিল। এমন পরিস্থিতিতে খুচরা বাজারে পণ্যটির দাম আরও বেড়েছে। প্রতি ডজন (১২ পিস) ফার্মের মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে রেকর্ড ১৮০ থেকে ১৯০ টাকায়।
এবিষয়ে সোমবার (১৪ অক্টোবর) সন্ধ্যায় কাওরান বাজার পরিদর্শন শেষে বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, পণ্যের সিন্ডিকেট করে যারা দাম বাড়িয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখনো যারা সিন্ডিকেট করে কারসাজির চেষ্টা করছে, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। তিনি আরও বলেন, বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যেসব পণ্যের সরবরাহ ঘাটতি আছে সেগুলোর বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। দ্রব্যমূল্যের দাম না কমাকে ব্যর্থতা হিসাবে মনে করেন কিনা প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, না, বাজার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দুই মাস যথেষ্ট সময় নয়। তবে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সৃষ্টির মাধ্যমে সবকিছুকেই নিয়ন্ত্রণে আনা হবে।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর ফার্মের মুরগির ডিম এবং ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। বেঁধে দেওয়া দাম অনুসারে উৎপাদক পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম ১০ টাকা ৫৮ পয়সা, পাইকারি পর্যায়ে ১১ টাকা ১ পয়সা ও খুচরা পর্যায়ে ১১ টাকা ৮৭ পয়সা হওয়ার কথা। সে হিসাবে খুচরা পর্যায়ে এক ডজন ডিমের দাম হয় ১৪২ টাকা। কিন্তু খুচরা বাজারে রোববার পর্যন্ত প্রতি ডজন ১৭০ টাকায় বিক্রি হলেও সোমবার ১৮০-১৯০ টাকায় ডিম বিক্রি হয়।
দুই সপ্তাহ ধরে ডিমের বাজারে অস্থিরতা ঠেকাতে মাঠে নামে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। যৌক্তিক মূল্যে ডিম বিক্রি না করায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাও করেছে। পাশাপাশি অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ফার্ম থেকে প্রতিপিস ১১ টাকায় কিনে পাইকারি আড়তেই ১৫ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। সে কারণে ভোক্তা পর্যায়ে এই ডিম ১৬-১৮ টাকার ওপরে বিক্রি হয়েছে। আর এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে রাজধানীর ২২ জন ব্যবসায়ী। এছাড়া তেজগাঁও ডিম আড়তদারদের কারসাজিতে ২০ দিনে ভোক্তার পকেট থেকে ২৮০ কোটি টাকা লুটে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ)।
তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আমানত উল্লাহ জানান, সরকার খুচরা পর্যায়ে ডিমের যে দাম নির্ধারণ করেছে, তার চেয়ে বেশি দাম দিয়ে খামারিদের কাছ থেকে ডিম কিনছেন তারা। এ কারণে বিক্রিও করতে হচ্ছে বাড়তি দামে। উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, গতকাল (রোববার) রাতে তারা পাইকারিতে ডিম বিক্রি করেছেন প্রতিটি ১২ টাকা ৫০ পয়সা দরে। এই ডিম তারা কিনেছেন ১২ থেকে ১২ টাকা ২০ পয়সা দরে। তিনি জানান, তেজগাঁওয়ে দৈনিক ১৪-১৫ লাখ ডিম আসে। ঢাকায় ডিমের চাহিদা এক কোটি। তেজগাঁওয়ের বাইরে কিছু জায়গায় অনেকে ঠিকই উচ্চ দামে ডিম বিক্রি করছেন। কিন্তু বাড়তি দামে কেনাবেচার কারণে শুধু তাদের দায়ী করা হচ্ছে, অভিযান চালানো হচ্ছে। এজন্য ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছেন ব্যবসায়ীরা।
তিনি বলেন, সরকারের নিয়ম না মানলে জরিমানা ও শাস্তি হতে পারে। তাই এখন বিক্রি বন্ধ রেখে কী করা যায়, সে উপায় খুঁজছি। আজ (সোমবার) ভোক্তা অধিদপ্তরের কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। তবে সেখানে সভা থাকায় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারিনি।
সোমবার রাজধানীর বেশ কয়েকটি খুচরা বাজার ঘুরে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খুচরা পর্যায়ে ফার্মের মুরগির ডিম প্রতি ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৮০-১৯০ ও সাদা ডিম ১৭০-১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি ফার্মের মুরগির দামও চড়া। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৯০-২০০ টাকা ও সোনালি মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৮০-২৯০ টাকা।
এদিন দুপুরে কাওরান বাজারের চিত্র, এই বাজারের কোনো দোকানে ফার্মের মুরগির বাদামি রঙের ডিম বিক্রি হচ্ছে না। শুধু একটি দোকানে কয়েকটি লাল ও দুই ডজনের মতো সাদা রঙের ডিম পাওয়া গেছে। এসব ডিমের ডজন ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। যদিও সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই লাল ডিমগুলো বিক্রি হয়ে যায়।
পাহাড়তলীতে ডিমের আড়তে তালা:
সরকার নির্ধারিত দামে ডিম বিক্রি করতে না পারায় চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে সোমবার সকাল থেকে আড়তগুলো বন্ধ রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। এ কারণে চট্টগ্রামে ডিমের বাজার আরও অস্থির হয়ে উঠছে। পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে উৎপাদন পর্যায় থেকে প্রতিপিস ডিম ১০ টাকা ৫৮ পয়সা করে কিনতে এবং পাইকারিতে সেটি ১১ টাকা ১ পয়সা করে বিক্রি করতে। কিন্তু উৎপাদন পর্যায় থেকে ডিম কিনতে খরচ পড়ছে ১৩ টাকা ১০ পয়সা থেকে ১৫ পয়সা। খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ১৬ টাকায়। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে ক্রয়-বিক্রয় করতে না পারায় আড়ত বন্ধ রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বেঁধে দেওয়া দামে ডিম ক্রয় ও বিক্রি করা যাচ্ছে না।
তবে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলেন, ডিমের আড়তদাররা বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে ও ডিমের দাম বাড়াতে আড়তগুলো বন্ধ রেখেছে। এতে ভোক্তাপর্যায়ে ডিমের দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া তারা (আড়তদাররা) প্রশাসনকে অসত্য তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।
পাহাড়তলী বাজারের আড়তদার কামরুল হুদা গণমাধ্যমে বলেন, আমরা ডিমের ব্যবসা নিয়ে উভয় সংকটে আছি। উৎপাদন পর্যায় থেকে ডিম ক্রয় করলে রসিদও দেওয়া হচ্ছে না। ভোক্তা অধিকার থেকে আমাদের কাছে ক্রয়ের রসিদ চায়। আমরা কীভাবে ক্রয়ের রসিদ দেব? রসিদ না থাকায় আমাদের জরিমানা করা হচ্ছে। কিন্তু উৎপাদন পর্যায়ে যে বেশি টাকা রাখছে। সেটি ভোক্তা অধিকার শোনে না। ডিম ক্রয় করতে না পারায় আমাদের আড়তগুলো আপাতত বন্ধ রাখছি।
আপনার মতামত লিখুন