দেশের শক্ত অবস্থান গড়ার যে সুযোগ ২০২৪-এর ৫ আগস্ট সৃষ্টি হয়েছিল সেই জায়গাটা সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ঐক্যের বন্ধন জুলাই গণঅভ্যুত্থান তৈরি করেছিল তা এখন দুর্বল হয়ে গেছে। এখান থেকে ফিরে আবার দেশের জন্য শক্ত অবস্থান তৈরি হওয়ার পথ দেখা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করছেন, এর পেছনে মূল কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর আলাদা আলাদা চিন্তার বহিঃপ্রকাশ নেতাদের মন্তব্যে স্পষ্ট হচ্ছে।
বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) অন্য দলগুলোর মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। দলগুলোর মধ্যে কাজ করছে নানা সমীকরণ। কিছু বিষয় অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রীয় নানা পক্ষকে বৈরিতার পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
দেশের বর্তমানে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ নেতাকর্মীদের বক্তব্য এখন রাজনৈতিক বিভাজনটা প্রকাশ্যে এসেছে। তবে রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যের পেছনে যুক্তি এবং বাস্তবতা রয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
দেশে বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা একটি জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের সেনাবাহিনী বলছে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, অন্যদিকে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিও তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কণ্ঠে জানিয়ে দিয়েছেন, তারা ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চান। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছর জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে এমন কথাই বলছেন।
এ ধরনের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য শুধু সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে না, বরং নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আস্থাহীনতাকেও আরও বাড়িয়ে তুলছে। এ অবস্থায় বিএনপি এবং যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সব রাজনৈতিক দলই চায় ডিসেম্বরে নির্বাচন হোক। তারা মনে করছেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দেশে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। তাই সঠিক সময়ে বর্তমান সরকারকে নির্বাচন দিতে হবে। যদি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হয় তবে দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা থাকবে না।
গত বুধবার বিকালে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ‘তারুণ্যের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সমাবেশে’ ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারমান তারেক রহমান অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা শুরু হয়েছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে মনে হয় এরই ভেতরে টালবাহানা শুরু হয়েছে বা চলছে। কথিত অল্প সংস্কার আর বেশি সংস্কারের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচনের ভবিষ্যৎ। এরই ভেতরে জনগণ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, সংস্কার নিয়ে সময়ক্ষেপণের আড়ালে অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে এবং বাইরে কারও কারও মনে হয় ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে।
তারেক রহমানের এই বক্তব্যের পর থেকেই দলের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যেই বর্তমান সরকারের প্রতি আস্থাহীনতার বিষয় প্রকাশ করছেন। তারা দ্রুত রোডম্যাপ জারি করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলছেন।
গত শুক্রবার (৩০ মে) বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দেশে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। তাই সঠিক সময়ে বর্তমান সরকারকে নির্বাচন দিতে হবে। এই সরকার বলেছিল তারা জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দেবে, সেটাই তাদের প্রধান দায়িত্ব ছিল। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দেশে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। তাই সঠিক সময়ে বর্তমান সরকারকে নির্বাচন দিতে হবে।
একই দিন রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে অসহায়দের মধ্যে কাপড় বিতরণ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিএনপি এবং যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সব রাজনৈতিক দলই চায় ডিসেম্বরে নির্বাচন হোক। প্রধান উপদেষ্টা কেন বিএনপিকে নির্বাচন নিয়ে দোষারোপ করলেন তা বোধগম্য নয়। পুরো জাতি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে। কেবল একটি দল নির্বাচন চায়- প্রধান উপদেষ্টার এমন বক্তব্য সঠিক নয়।
একইভাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেওয়ার দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন না হলে আর কখনো এ দেশে নির্বাচন হবে না। এই বাংলাদেশ বিদেশি প্রভুদের হাতে পদানত হবে। এ সময় টোকিওতে অবস্থানরত প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করেন মির্জা আব্বাস।
তবে বর্তমান যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা চলমান থাকলে দেশের স্বার্থ নষ্ট হবে বলে মনে করছে অনেক দল। তারা জাতীয় ঐক্য ধরে রেখে সরকারকে সময় দিতে রাজি। তবে এই সময়টা খুব বেশি দিতে চান না তারা।
বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাইলেও জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কথায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আস্থা আছে বলে জানিয়েছেন দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান।
তিনি বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা একাধিকবার বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন তিনি এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে সম্পন্ন করতে চান। এতে আমাদের আস্থা রয়েছে।
আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে সব ধরনের প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়েছে জানিয়ে ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে অনুষ্ঠিত গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করেছি। চলতি বছরের ডিসেম্বর ও আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে বলে প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন।
তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) তার কথায় শক্ত আছেন বলে আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, এমন একটি নির্বাচন হবে যেটা ইতিহাস সৃষ্টি করবে এবং প্রত্যেকটি মানুষ ভোট দিয়ে হাসি মুখে বের হবে। আমরা বিশ্বাস করি, তিনি ওই সময়ের মধ্যে নির্বাচন দেবেন।
দেশে নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপি ও সমমনা দল এবং জামায়াত যে অবস্থানে রয়েছে তাদের সেই অবস্থানের সঙ্গে পুরোপুরি একমত নয় জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদান ও পরবর্তীতে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি)। দলটির নেতারা কোনোভাবেই মৌলিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচন করতে নারাজ। এমনকি সংস্কার ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হতে পারে না বলেও জানিয়ে দিচ্ছেন দলটির নেতারা।
নির্বাচনকালীন অন্তর্র্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি রূপরেখা প্রস্তাব করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তারা আইনসভার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করার কথা বলেছে।
এনসিপি সূত্র জানিয়েছে, এই প্রস্তাব ২৫ মে ই-মেইলের মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে পাঠানো হয়েছে। কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শুরু হলে প্রস্তাবটি সরাসরি হস্তান্তর করা হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, আমরা অন্তর্র্বর্তী সরকারকে বলছি, নির্বাচন আপনি নির্ধারিত সময় অনুযায়ী করেন। কিন্তু নির্বাচনের আগে এই সংস্কার ও বিচার সম্পূর্ণ করেন এবং সেই পরিকল্পনার রোডম্যাপ জাতির সামনে উপস্থাপন করুন। অন্তর্বর্তী সরকার গণঅভ্যুত্থানের প্রতিশ্রুতি নিয়েই সরকার গঠন করেছে। আর এ প্রতিশ্রুতি হচ্ছে বিচার, সংস্কার ও মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। ফলে অবশ্যই এ সরকারকে তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হবে।
তবে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা ও স্বপ্ন অধরা থেকে যাচ্ছে, এ রকম শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, বিচার ও সংস্কার ছাড়া কেবল নির্বাচনের দিকে গেলে সেটা জনগণ ও গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে প্রতারণা হবে। আমরা সেই প্রতারণা কাউকে করতে দেব না। কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলকে সুবিধা বা ক্ষমতা দিতে কেউ রাজপথে নামেনি, কেউ জীবন দেয়নি। গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে যদি সরকার ব্যর্থ হয়, যদি কোনো রাজনৈতিক পক্ষ সেখানে বাধা তৈরি করে, তাহলে জনগণ আবারও রাজপথে নেমে আসবে। আমরা জীবন দিতে আবার প্রস্তুত থাকব।
দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, দিল্লির প্রেসক্রিপশনে বাংলাদেশের নির্বাচন হবে না। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ। দিল্লির কথায় কোনো দল বা ব্যক্তি কাজ করলে ১৮ কোটি জনতা ৫ আগস্টের মতো তাদের ঠেকিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকবে। দিল্লির কথায় বাংলাদেশে কোনো দল রাজপথ দখলের চেষ্টা করলে জনগণই তাদের প্রতিহত করবে।
দেশের স্বার্থে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বড় রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন জরুরি বলে মত কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতার।
ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এনডিপির চেয়ারম্যান কারি মুহাম্মদ আবু তাহের বলেন, দেশ এক সংকটময় অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বিএনপি ও জামায়াতের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দূর করে জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে সামনে রেখে একসঙ্গে দেশ গড়ার অঙ্গীকার গ্রহণ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপির মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। অভিযোগ উঠছে, একটি মহল সুপরিকল্পিতভাবে বিএনপিকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, মহান জুলাই বিপ্লবের ঐক্যকে নষ্ট করার প্রয়াস চালানো হচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা দল বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে বর্তমানে তীব্র মতবিরোধ ও সংঘাত দেখা দিয়েছে। বহিঃশত্রু সর্বদা রাজনৈতিক শরিকদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধ থাকা ও পারস্পরিক সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি।
বিকেপি/ওএফ
আপনার মতামত লিখুন